NRC আতঙ্ক, ইতিমধ্যে ২০১৩ সাল থেকে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের সংশোধিত আইনের প্রেক্ষিতে অসমে শুরু হল জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বানানোর কাজ, যার ফলে অসমে ভারতীয় নাগরিকত্ব হারান প্রায় ১৯ লক্ষ জনসাধারণ । পূর্ব অনুমান হিসাবকে ছারিয়ে বিরাট অংকের বাঙ্গালী হিন্দুরাও এর আওতায় পরেছে। যার আঁচ পেতেই নড়েচড়ে বসে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন গুলি। কিন্তু এই ১৯ লক্ষ জনসাধারণের মধ্যে বিরাট সংখ্যাই যে আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক ও রয়েছে, সেই দিক দিয়ে কোন রাজনৈতিক দল কিংবা তথাকথিত কিছু আদিবাসী সংগঠন কোন প্রতিবাদ করার প্রয়োজনি মনে করেনি , একবার এই বিষয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন, আদিবাসীরা এই ভারতীয় ভুখন্ডে প্রথম থেকেই বাস করে আসছে, তাদের আবার কিসের NRC , কোন যুক্তিতেই বা এই আদিবাসীদের দিতে হবে তাদের ভারতীয় হবার প্রমানপত্র । শুধু কি NRC আরো বহুদিক থেকে চলছে আদিবাসীদের ভিটেমাটি ছাড়া করার এক জঘন্য চেষ্টা। যদিও আমি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না তবুও আজ আমি এই বিষয়টি তুলে ধরতে চাই, কারণ আমিও একজন আদিবাসীর সন্তান, তাই বাকি ভাই বোনদের সজাগ করতে আমার এই প্রতিবেদন, - বোকা আদিবাসী, এবার একটু চালাক হও । মানছি সরলতা তোমার বৈশিষ্ট্য কিন্তু এই সরলতা কে দুর্বলতা বানিয়ে ফেলোনা,। যাতে এমন না ঘটে তোমাদের ভুমিতেই তোমাদেরকেই ডিটেনশন ক্যাম্প নামক জেলে অথবা গোলাম হয়ে থাকতে না হয়।
|
আদিবাসী অনুষ্ঠান |
NRC বিষয়ে কিছু কথা
১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান স্বাধীন ভারতীয় ভুখন্ডে কার্যকরী হয়, তাছাড়াও ভারত পাকিস্তান দেশ ভাগের ফলে, ভারতে থাকা ভারতীয় জনসাধারণের নাগরিক পঞ্জিকরনের বিশেষ প্রয়োজন পরে
তাই ১৯৫১ সালে নাগরিক পঞ্জিকরনের কাজ শুরু করার চেষ্টা হয় কিন্তু সেটা সম্পুর্ন হয়নি। এরপর ১৯৫৫ সালে আসামে পুনরায় ভারতীয় নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় পঞ্জী তৈরি করার জন্য ও উন্নীতকরণের জন্য নাগরিকত্ব আইন-১৯৫৫ আনা হয়, যেখানে ভারতীয় নাগরিক বলতে ভারতের সংবিধান ও নাগরিকত্ব আইন-১৯৫৫ র অধীনে সংজ্ঞাবদ্ধ ভারতীয় নাগরিকদেরকে বোঝানো হয়, যার
কিছুটা পরিবর্তন করে ২০০৩ সালে পুনরায় ফিরে আনা হয় এবং এতে বলা হয় এটি এমন একটি পঞ্জী যেখানে ভারত ও ভারতের বাইরে থাকা ভারতীয় নাগরিকদের বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে হবে যাতে ভারতীয় জনসাধারণ দের আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় ।
।আদিবাসীদের উপর NRC এর প্রভাব।
বড় আশ্চর্যের বিষয় হলো, ১৯৫০ থেকে চলে আসা এই পঞ্জিকরনে একবারো আদিবাসীদের হিতে কোন কিছুই চিন্তা করা হয়নি। প্রথম থেকেই এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ বিভিন্ন বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে, কখন বা সেটা ধর্মের নামে, কখন বা সেটা জাতির নামে ।
|
আদিবাসী পুরুষ নৃত্য |
DNA পরীক্ষার দ্বারা এটা প্রমাণিত, আদিবাসীরাই হলেন এই ভুমির প্রকৃত ভাগীদার, আর বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রমানো বলে ( বোঘাজকোই লিপি, আর্মেনীয় লিপি) আর্যরা ভারতে ইউরাল পর্বতের দক্ষিণ পশ্চিম কোন থেকে ভারতে আসে, কিন্তু লজ্জার কথা এই যে, আর্যজাতিরা এই ভারতে এসে ছলে, বলে, কলে-কৌশলে আজ এদেশের ধর্মনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ দখল করে বসে আছে। আর এই উন্নয়নশীল দেশে পর্যাপ্ত শ্রমিকের চাহিদা মেটাতে এই সরল মনের আদিবাসীদের উপর ধিরে ধিরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন আইনের বোঝা, যাতে তারা তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে ও অধিকার হারিয়ে উচ্চবর্ণের গোলামে পরিণত হয়ে এই উন্নয়নশিল দেশের পর্যাপ্ত শ্রমিকের চাহিদা মেটাতে পারে।
অরন্যের অধিকার থেকে বঞ্চনা
ডঃ বি. আর. আম্বেদকরের সভাপতিত্বে যখন সংবিধানের খসরা প্রস্তুত করেন, তখন বাবা
আম্বেদকর সংবিধানের পঞ্চম তফসিলের 2- এর A নং ধারা ও 2-এর B নং ধারাতে অরন্যের উপর আদিবাসীদের অধিকার মৌলিক অধিকার হিসাবে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং এটাও বলা হয়েছে যদি কেও সেই অধিকার থেকে তাঁদের কোনরূপ বঞ্চিত করে তবে রাষ্ট্র তাঁদের এই অধিকার সুরক্ষা করবে। কিন্তু ঘটছে তার উল্টোটাই, যেখানে রাষ্ট্রের কর্তব্য আদিবাসীদের রক্ষা করার, সেখানে রাষ্ট্রই উঠে পরে লেগেছে, এদের জমি থেকে বেদখল করার। যার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হল, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি অরুন মিশ্রের ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে আদিবাসীদের প্রতি এক অমানবিক রায়।আর সেই রায়টি হল -"যে সকল আদিবাসীদের পাট্টার আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে সেই পরিবার গুলিকে আগামী 27 জুলাইয়ের মধ্যে উচ্ছেদ করতে হবে " । যার ফলে কত লক্ষ আদিবাসী মানুষ যে গৃহহীন হবে তার কোন হিসেব নেই। এমন অদ্ভুত দেশে এমনটা আশা করা মোটেও বোকামি নয়, যে দেশের সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি এটা বলতে পারেন - ব্রাম্হনরা দুবার জন্মগ্রহণ করেন, তাই দেশের উচ্চপদ গুলি তাদেরি প্রাপ্য। তবে সেই দেশের বিচার ব্যবস্থায় কি করে সুবিচার আসা করব।
|
আদিবাসী নারি নৃত্য |
আমার কিছু কথা
আদিবাসীরা যাতে ধীরে ধীরে তাঁদের অরন্যের অধিকার, নাগরিকত্বের অধিকার সব গুলো থেকে বঞ্চিত হয় তার গভীর ষড়যন্ত্র চলেছে। একদিকে NRC একদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে সুপ্রিমকোর্টের এক ব্রাহ্মন বিচারপতি অরুন মিশ্রের আদিবাসী বিরোধী রায় আদিবাসীদের জাঁতাকলের মত দু দিক দিয়েই পিষে মারবে, NRC তে নিজেকে ভারতীয় প্রমান করার জন্য, মোট ১৪ টি নথিপত্রের কথা বলা হয়েছে আর মালিকানা সংক্রান্ত নথিপত্র পাওয়া বাস্তবেই জটিল , ফলে দরিদ্র, সরল, সাধারন অক্ষরজ্ঞানহীন আদিবাসীদের পক্ষে বারবার প্রশাসনের কাছে গিয়ে উপযুক্ত নথি জোগাড় করা সম্ভব হয়না, এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আজকে আমি এই প্রতিবেদন লিখছি কেন জানেন, মনে বড় ব্যথা - আর সেই মনের ব্যথা নিয়ে অনেক কিছুই বলতে চাই , কিন্তু আজ অল্পই বলব । আমাদের দেশে যতগুলো আদিবাসি সম্প্রদায় রয়েছে তার মধ্যে
সাঁওতাল সম্প্রদায় সংখ্যা গরিষ্ঠ। আমি দেশের অবস্থা নিয়েই শুধু সমালোচনা করবো তা নয়, সাথে আদিবাসিদের সমালোচনা ও করবো, জানি এই আদিবাসী সম্প্রদায় একসময়ের এক উন্নত সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতা তৈরি করেছিল, আর সিন্ধু সভ্যতার দ্বারা প্রমান পাওয়া যায় এই আদিবাসীদের প্রকৃত যোগ্যতা, ৩৫০০ বছর আগে গড়ে তোলা এই সভ্যতাই বাড়ি বাড়ি ছিল পৌরসভা ব্যবস্থা, যেটা আধুনিক কালের কোন সরকারই এখনো দিতে পারেনি। তাই আমি আমার আদিবাসী ভাইয়েদের জানাতে চাই, সময় হয়েছে নিজের সমালোচনা করার, নতুন করে ঘুরে দাঁরাবার, সময় হয়েছে বাড়ি বাড়ি মদ না বানিয়ে, বাড়ি বাড়ি নেতৃত্ব তৈরি করার। বর্তমানে এই আদিবাসি সমাজ বহু সমস্যাই জর্জরিত, আশাকরি সেই সমস্ত সমস্যা গুলো আপনারা জানেন, সেই সমস্ত সমস্যা গুলো আমি এখন এই জন্য বলছি না, কারণ এটা আমার পুরোনো অভিঙ্গতা, যখনি আমি এর বিরুদ্ধে বলতে গেছি তখনি আমি দিকু। তবে ভালোবাসা তো ভালোবাসাই হয়, স্বজাতির উপর এমন সংকোটময় মহুর্তে যখন সবাই বর্তমান পরিস্থিতির হাল হকিকত না জেনে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে , তখন আমার এটা কর্তব্য তাদের ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা না করে তাদের আগাম জানান দেওয়া যে সময় হয়েছে পরিবর্তনের।
সুমন্ত হেমরম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন