বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
শিলিগুড়ির ইতিহাস: কীভাবে একটি গ্রাম থেকে একটি মহানগর হয়ে উঠল।। History of Siliguri: How a Village Became a Metropolis।।
শিলচাগুড়ি শিলিগুড়ি
শিলিগুড়ি শহরের ইতিহাস বেশ ঐতিহ্যবাহী ও রোমাঞ্চকর। তিস্তা, মহানন্দা, বালাসন, জলঢাকা নদী দ্বারা ঘিরে রাখা একটি সুন্দর শহর। পাহাড়ী নদী, সমতলীয় নদী শিলিগুড়িকে যেমন সৌন্দর্য প্রদান করেছে , তেমনি জীবনের রুপরেখা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা গ্রহন করেছে। বলাবাহুল্য পাহারের পদতলে থাকা শিলিগুড়ি একসময় নুড়িপাথরে ভরা জঙ্গলময় সমতল ভূমি ছিল। তাই এই অঞ্চলটি পূর্বে শিলচাগুড়ি নামে পরিচিত ছিল। যার অর্থ নুড়িপাথরের ঢিবি। এই শিলচাগুড়ি নামটি আজ শিলিগুড়ি নামে পরিচয় লাভ করেছে। নামটি কোন জাতিরা দিয়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। একটি মতামত হল যে, এই নামটি ভুটানিরা দিয়েছে। ভুটানিরা এই স্থানকে শিলচাগুড়ি বলতেন, যার অর্থ হল শিলা বা পাথরের গুড়ি। একটি অন্য মতামত হল যে, এই নামটি ব্রিটিশরা দিয়েছে।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
এই শহরটি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন রাজ্য, সংস্কৃতি ও বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এত মনোরম আবহাওয়া যুক্ত, সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ, উর্বর ভূমি সর্বপরি তিন দিক দিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান দেশের সাথে খুব সহজেই সংযোগ স্থাপন, উত্তর পূর্ব ভারতের প্রবেশের জন্য প্রবেশ পথ এছাড়াও আরো কয়েকটি দিক রয়েছে যার দরুন শিলিগুড়ি ভারত তথা বিশ্বের কিছু দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে পরিচয় পেয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই শিলিগুড়িকে দখলের চেষ্টা আগেও দেখা গিয়েছে এবং এখনো দেখা যাচ্ছে।
সেবকের ঐতিহ্য বাহী করোনেশন ব্রিজ |
পূর্বে সিকিম যখন ভারতের অংশ ছিল না তখন সিকিমের চোগিয়াল রাজা শিলিগুড়ি কে দখলে ছিল। এই সময় ১৭৭৫ সাল থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যে নেপাল থেকে বহু নেপালি সিকিমে প্রবেশ করতে শুরু করে যার তীব্র বিরোধিতা করে সিকিম সরকার। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশরা সিকিমের কাছে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় এবং যার ফলে গোর্খা নেপালিরা হয়ে উঠে ব্রিটিশ এবং সিকিমের কমন শত্রু। নেপালিরা ইতিমধ্যে শিলিগুড়ির পার্শ্ববর্তী এলাকা দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু ১৮১৬ সালে ব্রিটিশ নেপাল যুদ্ধ হলে , নেপাল পরাজিত হয় এবং সৌগলির চুক্তি করে এবং দখলকৃত জায়গা শিলিগুড়িকে ফিরিয়ে দেই। ব্রিটিশদের ক্ষমতা এবং প্রভাব সিকিমের উপর দিন দিন বাড়ছিল। ব্রিটিশরা সুযোগ বুঝে একসময় তারা দার্জিলিং এ আধিপত্য বিস্তার করে। এতে শিলিগুড়ির দায়ভার চলে আসে ব্রিটিশ সরকারের হাতে। এই শিলিগুড়ি থেকে ব্রিটিশরা তাদের ব্যবসায়িক সামগ্রী পাহাড়গুলোতে রপ্তানি করতে শুরু করে।
রেলগাড়ি সংযোগ
ব্রিটিশরা প্রধানত শিতপ্রধান দেশের নাগরিক ছিল পাশাপাশি চায়ের চাহিদা ব্রিটেন সহ গোটা বিশ্বে বাড়ছিল। সুযোগ বুঝে শিলিগুড়িকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশরা দার্জিলিং শহরকে দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে তৈরি করে। যার ফলস্বরূপ দার্জিলিং যাতায়াত এবং চা পাতা পরিবহনের জন্য ব্রিটিশদের শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং প্রযন্ত রেল ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য করে ১৮৭৮ সালে এবং শিলিগুড়ি শহরটি গড়ে তোলা হয় শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন (একমাত্র হেরিটেজ রেলষ্টেশন)। এই ষ্টেশনে বহু বিখ্যাত ভারতীয় স্মৃতি বহন করে রেখেছে, যেমন - মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঘা যতিন প্রমূখ। আবার ১৮৮০ সালে ন্যানো গ্যাজের রেলওয়ে ব্যবস্থা চালু করা হয়, যা এখনও হিমালয়ান রেলওয়ের ট্রয় টেন হিসেবে বিখ্যাত, এবং এটিও বিশ্ব হেরিটেজ হিসাবে নথিভুক্ত।
শিলিগুড়ি টয় ট্রেন |
চিকেন নেক
ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাবার আগে ভারতের বৃহৎ ভূ-খন্ডকে ভারত এবং বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) হিসেবে সিরিল রেডক্লিভ শিলিগুড়ির উপর দিয়ে বয়ে চলে যাওয়া মহানন্দা নদী যেখানে বাংলাবান্ধা পার করেছে সেখান থেকে নদীর এপার ভারত এবং ওপার বাংলাদেশ হিসেবে ভাগ করেন। যার ফলে শিলিগুড়ির একপাশে নেপাল অন্যপাশে বাংলাদেশ থাকার ফলে উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে সমগ্র ভারতের ভূ যোগাযোগের খুবই পাতলা সরু করিডোরের তৈরি হয়েছে, যেটি আজ শিলিগুড়ি চিকেন নেক করিডর হিসাবে পরিচিত। মূলতঃ যে কোনো দেশ এই স্থানটি দখল করলে ভারতের মূল ভূ-খন্ডের সাথে উত্তর পূর্ব ভারতের যোগাযোগ নষ্ট হতে পারে। সুতরাং ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই করিডোরের গুরুত্ব অসীম।
আরো পড়ুন - বালুরঘাটের ইতিহাস: প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগের এক শহর।।
তবে এত কিছুর পরেও শিলিগুড়ির অগ্রগতিতে বাধা পরেনি। যার দরুন ১৯৯৪ সালে শিলিগুড়িতে মিউনিসিপাল কর্পোরেশন তৈরী করে ফেলে নগর সৌন্দর্যায়ন প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
বালুরঘাটের ইতিহাস: প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগের এক শহর।। History of Balurghat: A City from Ancient to Modern Age।।
বালুরঘাট দক্ষিণ দিনাজপুরের সদর, সময়ের উত্থান পতনের ইতিহাস বয়ে নিয়ে আজ একুশ শতকের আঙ্গিনায় পৌঁছে গেছে। বর্তমানে একুশটি ওয়ার্ড নিয়ে তৈরি বালুরঘাট পৌরসভা। এক সময় পশ্চিম দিনাজপুরের অংশ হিসেবে বালুরঘাট শহর প্রতিষ্ঠিত থাকলেও পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে দক্ষিণ দিনাজপুর এবং উত্তর দিনাজপুর পৃথক ভাবে অস্তিত্বে এলে বালুরঘাট দক্ষিণ দিনাজপুরের সদর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
আত্রেয়ী নদীর তীরে গড়ে উঠা এই ছোট শহরে, আত্রেয়ী নদীর জলপ্রবাহের ধারার মতো বয়ে গেছে যুগের পর যুগ। প্রাচীন থেকে বর্তমান সবকিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে এই শহরে।
প্রাচীন যুগ
বালুরঘাটের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে ইতিহাসের ধারা, প্রাচীন যুগে মৌর্য, গুপ্ত, কুষাণ, শুঙ্গ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বালুরঘাট ছিল অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীন যুগে বালুরঘাট পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের অংশ ছিল। বেদে উল্লেখ একটি বিশেষ জাতির লোকেরা পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল। পুন্ড্রবর্ধনের অস্তিত্বে বালুরঘাটের ইতিহাস সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষন না বালুরঘাটের পার্শ্ববর্তী এলাকা বা দক্ষিণ দিনাজপুরের ইতিহাস যুক্ত না করা হয়। হরষেন রচিত প্রাচীন গ্রন্থ বৃহৎ কথা কোষ অনুযায়ী মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থাপক চন্দ্রগুপ্ত পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের দেবীকোট শহরের এক ব্রাহ্মণের সন্তান ছিলেন। বর্তমানে এই দেবীকোট হিসেবে গঙ্গারামপুরকে চিহ্নিত করা হয়। এই সময় দেবীকোট ছিল ব্রাহ্মণদের আশ্রিত মন্দিরে পরিপূর্ণ শহর। আবার আরেক তথ্য অনুযায়ী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জৈন গুরু ভদ্রবাহু দেবীকোটে জন্মগ্রহণ করেছিল।
গুপ্ত যুগে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাষন কাল থেকেই বালুরঘাট তথা তার পার্শ্ববর্তী এলাকা উন্নতি লাভ করতে থাকে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উত্তর পুরুষ হিসেবে দ্বিতীয় কুমার গুপ্ত তার এই কার্যকলাপকে অনবরত রাখেন , এবং কয়েকটি বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করেন। দ্বিতীয় কুমার গুপ্তের নাম অনুসারে বালুরঘাটের পার্শ্ববর্তী একটি এলাকার নাম হয়েছে কুমারগঞ্জ। হিলির বৈগ্রাম নামের একটি গ্রামে একটি তাম্রপট্ট ( তামার পাতলা পাতের উপর লিখিত আকারে দস্তাবেজ) পাওয়া গেছিল, যেটি থেকে প্রথম কুমার গুপ্ত এর জমি ব্যবস্থা জানা যায়। যেখান থেকে বোঝা যায় যে এই এলাকায় গুপ্ত শাষকের রাজ ছিল। এখনো দক্ষিণ দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে উঠে আসা প্রাচীন কালের মূর্তিগুলো সেই সময়ের শিল্পকলার উৎকর্ষতা প্রমাণ করে আসছে প্রতিনিয়ত।
মধ্যযুগ
প্রাচীন যুগের বিষয়ে তেমন কিছু তথ্য না পাওয়া গেলেও মধ্য যুগে বালুরঘাট এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহের উন্নতি সাধন হয়েছিল তা নিঃ সন্দেহে বলা যায়। বিশেষ করে পাল সাম্রাজ্যের সময়ে, পাল যুগের কয়েকটি রাজার নাম অনুসারে বালুরঘাটের পার্শ্ববর্তী কয়েকটি এলাকার নাম রয়েছে, যেমন - মহিপাল, রামপুর, গোপালপুর, এছাড়াও আরো কয়েকটি স্থান রয়েছে।
প্রথম মহিপাল প্রজাহৈতষী রাজা হিসেবে পরিচয় লাভ করেন। তিনি উত্তরবঙ্গ সহ পূর্ব বঙ্গের বেশ কিছু রাজ্যে জয়লাভ করেন, যার ফলে বালুরঘাট তার রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। কৃষক তথা জনগণের জন্য কয়েকটি দিঘী খনন করেন, যার একটি রয়েছে মহিপাল এলাকায়, যেটি বর্তমানেও মহিপাল দিঘী নামেই পরিচিত।
তবে এখানেই শেষ নয়, পাল সাম্রাজ্যের অন্যতম রাজা ধর্মপাল যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেন, তার একটি বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণ দিনাজপুরের কোন এক স্থানে করেছিলেন, অনেক ঐতিহাসিকদের মতে সেটি বর্তমানে হরিরামপুর অথবা বালুরঘাটের কোনো পাশ্ববর্তী এলাকাতে অবস্থিত ছিল।
পাল বংশের অবনতি ঘটতে থাকে দ্বিতীয় মহিপালের সময়ে, তার দ্বারা শাসিত ১০৭০-১০৭৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব কালে তার অপশাসন কৈবর্ত জনগনকে বিদ্রোহ করে তুলেছিল। কৈবর্তরা দিব্যক নামের এক নেতার নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। বালুরঘাট থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত মুরারীবাদ নামের স্থানে কৈবর্তরা একত্রিত হয়ে দিব্যক, ভিম নামক নেতাদের নেতৃত্বে যুদ্ধের ঘোষণা করেছিল।
আরো পড়ুন - মালদার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।।
মধ্যযুগের ইতিহাস এখানেই থেমে থেকেছিল এমনটি না। দ্বাদশ শতকে দিকে বালুরঘাটের উপরে হিন্দু সেন বংশের রাজত্ব ছিল। এরপর ১২০৬ সালে বখতিয়ার খিলজীর দ্বারা হঠাৎ আক্রমনের মাধ্যমে লক্ষন সেন পালিয়ে গেলে, বালুরঘাট সহ দক্ষিণ দিনাজপুরে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হিন্দু ধর্মে পরিচালিত দক্ষিণ দিনাজপুরের মাটিতে মুসলিম শাসন লাভ করলে , হিন্দুদের মাঝে মুসলিম ধর্মের দর্শন তুলে ধরার প্রয়োজন পরে, যেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল মৌলানা আতা উদ্দিন শাহ, যার সমাধি এখনো গঙ্গারামপুরের ধলদিঘীতে রয়েছে। এমনকি বখতিয়ার খিলজীর সমাধি এখনো গঙ্গারামপুরে রয়েছে।
বালুরঘাট স্বাধীনতা সংগ্রাম |
এরপর ১৪৯৯-১৫৩৩ পর্যন্ত যে যে সুলতানরা শাসন করেছিলেন, তারা সকলেই বালুরঘাট এলাকায় বিশেষ নজরদারি রেখেছিলেন, যারা হলেন সামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ, নাসিরুদ্দিন নাসরত শাহ প্রমূখ। যাদের মধ্যে হুসেন শাহের নাম আজও সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয় বালুরঘাট লাগোয়া হোসেনপুর গ্রামে।
মুঘল আমলে বালুরঘাট মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে, কিন্তু এতবড় সাম্রাজ্যে মুঘল শাষকের একার দ্বারা পরিচালনা করা সহজ ছিল না। সুতরাং মুঘল শাষকের সহযোগী হিসেবে হিন্দু রাজা কাশীনাথ রায় বালুরঘাটের কাছেই আত্রেয়ী নদীর তীরে দূর্গ নির্মাণ করেন।
আধুনিক যুগ
সময়ের ব্যবধানে বালুরঘাট সহ সমগ্র বাংলাই ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে আসে , সেই সময় বাংলার এই অংশ শাসন করতেন রাজা রাধানাথ রাই। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বাংলার ফকির আর সন্ন্যাসীরা গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, যেখানে ফকিরদের নেতৃত্ব দিয়েছেন মজনু শাহ এবং সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দেন ভবানী পাঠক। মূলতঃ এরা রংপুর, কুড়িগ্রাম থেকে গেরিলা যুদ্ধের পরিচালনা হলেও, প্রয়োজনে বালুরঘাট কেও তারা গেরিলা যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করতেন।
স্বাধীনতা প্রেমী বালুরঘাট বাসিন্দাদের মধ্যে দেশভক্তি তুলে ধরতে একে একে কাজী নজরুল ইসলাম, মুকুন্দ দাস, এমনকি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বালুরঘাট পরিদর্শনে আসেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বালুরঘাটের আত্রেয়ী নদীর তীরে কংগ্রেসের কার্যালয় স্থাপন করেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বালুরঘাটের বাসিন্দারা একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৪২ সালের ভারতছাড়ো আন্দোলনে বালুরঘাটে নেতৃত্ব দেন সরোজরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, কানু সেন, শুটকা বাগচী প্রমূখ। আত্রেয়ী নদীর পূর্বতীরে সমবেত হন প্রায় ১০ হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা, যারা ১৪ ই সেপ্টেম্বর বালুরঘাটের ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত থানা এবং অনেক কয়েকটি প্রশাসনিক ভবনের দখল নিয়ে উত্তোলিত ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক সরিয়ে ভারতের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বালুরঘাট থানার দারোগা সহ সকলে পালিয়ে প্রান বাঁচায়। আন্দোলন কারীদের রোষানলে সেদিন বালুরঘাটে প্রায় ১৬টি অফিস ভস্মীভূত হয়েছিল। টেলিফোনের তার কেটে যানবাহন থেকে সড়ক সংযোগ, সবই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বালুরঘাট প্রথমবারের মত স্বাধীন হয় কিন্তু বালুরঘাট তিনদিন স্বাধীন থাকার পর বৃটিশ সরকার পুনরায় দখল নেয়। বালুরঘাটের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তাৎক্ষণিক সাফল্যের আগুন বালুরঘাটের আশেপাশের এলাকায় ছড়াতে দেরি হয়নি। দেখতে দেখতে ডাঙি, মদনাহার, তপন, লস্করহাট, পারিলাহাটে এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি পারিলাহাটে ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে আন্দোলন কারীদের খন্ডযুদ্ধ হয়, যেখানে মোট চার জন ভারতীয় শহীদ হন। অবশেষে পুলিশের অত্যাচারের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বালুরঘাট অভিযানের ১০ দিনের অধ্যায় সমাপ্ত হয়।
ব্রিটিশ সরকারের জোর পূর্বক খাজনা আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে বালুরঘাটের খাঁপুরে কৃষকরা এই অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। অর্ধেক নই, তিনভাগের একভাগ খাজনা হিসেবে গ্রহন করতে হবে সরকারকে। এই দাবিকে অস্ত্র করে ১৯৪৭- সালে ২০ ফেব্রুয়ারী প্রায় শতাধিক কৃষক মিছিলে বের হয়, মিছিলের দলটি এগিয়ে যেতেই ব্রিটিশদের পুলিশ বাহিনী মিছিলের উপর গুলি চালাতে থাকে। মোট ২২ জন কৃষক শহীদ এবং প্রায় ৫০ জন কৃষক পুলিশের গুলিতে জখম হন।
কিন্তু এত রক্তক্ষয় সংগ্রামের পরেও বালুরঘাট ১৫ আগষ্ট স্বাধীনতা লাভ করেনি। ১৫ আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা লাভের কালপঞ্জী ঘোষণা করা হলেও, বালুরঘাটের অস্তিত্ব পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে নাকি ভারতের সাথে যুক্ত হবে, তা নিয়ে বিড়াম্বনা দেখা দেয়। কেননা বালুরঘাট বাসিদের অন্তরে ভারতের সাথে যুক্ত হবার ইচ্ছা প্রবল ছিল, এবং সেই হিসেবে পাকিস্তানের সৈনিকদের বালুরঘাট ছেড়ে চলে যেতে হত ১৪ আগষ্টের মধ্যে। কিন্তু ১৪ অগাস্ট রাতে পাকিস্থানি সৈন্য বাহিনী ও পাকিস্তানি নেতারা বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ে হাজির হয় এবং সমস্ত কিছুর দখল নিতে থাকে। প্রায় গোটা বালুরঘাট ছেয়ে ফেলা হয় পাকিস্তানের পতাকায়। পরের দিন ১৫ অগাস্ট স্বাধীন পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বালুরঘাটে মহকুমা শাসক পানাউল্লা সাহেব পাকিস্তানের পতাকা তোলেন।
এই সময় ভারতের প্রতি ভালোবাসা সম্পন্ন বালুরঘাটের বেশ কিছু জায়গায় সাধারণ যুবক ও স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সশস্ত্র ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, এবং বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কুমুদরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় পাকিস্তানি পতাকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তুলতে বাধা দেন।
পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু স্থানে জনগনের এহেন প্রতিরোধে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ বালুরঘাট সহ বেশ কিছু এলাকাকে "নোশনাল এরিয়া" বলে ঘোষণা করতে বাধ্য হন। অবশেষে "নোশনাল এরিয়া" এর তকমা সরিয়ে দিয়ে ১৭ অগাস্ট বালুরঘাট সহ মোট পাঁচটি থানা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। তার ফলে পাকিস্তানি সেনাদের বালুরঘাট ছাড়তে হয় এবং ১৮ অগাস্ট সকালে বালুরঘাটে ভারতের সেনাবাহিনী প্রবেশ করে, এবং পাকাপাকি ভাবে ১৮ অগাস্ট বালুরঘাট ভারতের অংশ হিসেবে ভাবে স্বাধীনতা লাভ করে ও স্বাধীন বালুরঘাটে প্রথম সরোজরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় দ্বারা ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৩
মালদা জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।। SHORT HISTORY OF MALDA DISTRICT ।।
মালদা জেলার মালদা শহর পশ্চিমবঙ্গের বুকে এক অনবদ্য জায়গা করে নিয়েছে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ফজলি আম, গম্ভীরা গান, হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের বড় ধরনের আবেগ, প্রাচীন থেকে বর্তমান পর্যন্ত সুবিস্তৃত ইতিহাস এবং তার ধ্বংসাবশেষ সব কিছু মিলিয়ে মালদা যেন আজ বাংলার সম্মান স্বরুপ। প্রাচীন থেকে বর্তমান পর্যন্ত সুবিস্তৃত ইতিহাসের আঁতুড়ঘর মালদা। তাই বর্তমানে ইতিহাস প্রেমি দর্শনার্থীদের জন্য মালদা এক অনন্য গন্তব্য। চলুন হালকা করে জেনে নিই সেই ইতিহাস।
প্রাচীন কাল:
মালদা ছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন নামের রাজ্যের অংশ, যেখানে মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য এবং পাল সাম্রাজ্য দ্বারা শাসিত ছিল। চন্দ্রগুপ্ত নন্দ বংশকে পরাজিত করলে মগধ তার দখলে চলে আসে, আর মালদা সে সময় তার অংশ ছিল। এরপর বিন্দুসার রাজত্ব করে। বিন্দুসারের পর সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের বিভীষিকা দেখে অনুতপ্ত হলে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন ও প্রচারে ব্রতি হন এবং তার সাক্ষ্য হিসেবে অনেকগুলো শিলালিপি তিনি খদিত করান। যার কয়েকটি মালদাতে রয়েছে, উদাহরণ স্বরূপ ঘোষরায়ন পিলার এবং মাহাশথাঙ্গার শিলালেখ।
আদিনা মসজিদের ইতিহাস জানতে ক্লিক করুন -> আদিনা মসজিদের ইতিহাস
এরপর গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে সমুদ্রগুপ্ত থেকে স্কন্দগুপ্ত সকলের সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে মালদা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতিহাসের প্রবাদ প্রতিম ব্যাক্তি পাণিনি তার গ্রন্থ "অষ্টাধ্যায়ী" তে গৌরপুরা নামের একটি শহরের উল্লেখ করেছেন, সম্ভবত সেটি মালদাতে অবস্থিত ছিল। এমনকি চীনা পরিব্রাজক জুয়ানজাং পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুন্ড্রনগর পরিদর্শন করেন যেটি ছিল গৌরপুরার পাশ্ববর্তী এবং তিনি এখানে অনেক স্তূপ ও মঠ দেখেছিলেন।
পরবর্তীতে পাল সাম্রাজ্যের সময়ে গোপাল পাল থেকে শুরু করে একে একে ধর্মপাল,দেবপাল, মহিপাল, রামপাল, সকলেই রাজত্ব করেছেন। পাল রাজত্বের আমলে মালদার গৌড় হয়ে উঠেছিল প্রাণকেন্দ্র। মালদার পাশ্ববর্তী বর্তমানে যেটি পাহাড়পুর সেটি পালযুগে সোমাপুর নামে পরিচিত ছিল, যা ধর্মপালের আরেক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে মহিপাল মালদার পাশ্ববর্তী অনেক এলাকায় কৃষকদের জন্য জলাধার তৈরি করেন। এছাড়াও দেবপাল তৎকালীন মালদার জগদ্দলে বৌদ্ধ মঠ তৈরি করেছিলেন। প্রথম মহিপাল আদিনায় একটি হিন্দু মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও পালযুগের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে, যেমন সন্ধ্যাকর নন্দির রামচরিতমানস, খালিমপুর তাম্রলিপি , তারানাথের লেখা থেকেও মালদার তৎকালীন অবস্থার কথা জানতে পারা যাই।
মধ্যযুগে মালদা:
মধ্যযুগে পাল রাজাদের পরাজিত করে মালদাতে সেন রাজবংশের উত্থান হয়েছিল, এবং এই সেন বংশের রাজারা ধর্মীয় দিক দিয়ে হিন্দু ছিল। লক্ষন সেন রাজা হয়ে তাদের রাজধানী মালদার গৌড়ে স্থানান্তর করেন এবং তার নাম অনুসারেই তিনি তার রাজধানীর নাম রাখেন লক্ষ্মণাবতী, সুতরাং আমরা বলতে পারি মালদার পূর্বের নাম ছিল লক্ষ্মণাবতী। লক্ষন সেন একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন যা বর্তমানে মালদার রামকেলিতে অবস্থিত।
মালদা জেলার কিছু ঐতিহাসিক স্থান |
কিন্তু ১২০৬ খ্রীঃ বখতিয়ার খিলজী বর্তমানের মালদা তৎকালীন লক্ষ্মণাবতীতে আক্রমন করলে লক্ষন সেন পালিয়ে গেলে সেন রাজত্ব শেষ হয় এবং মালদাতে মুসলিম শাসন শুরু হয়। বর্তমানে মালদাতে ছরিয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো মুসলিম আমলেই তৈরি যেমন- আদিনা মসজিদ, ছোটসোনা মসজিদ,বড়সোনা মসজিদ,ফিরোজ মিনার, লোটন মসজিদ, চিকা মসজিদ এবং দাখিল দরওয়াজা ইত্যাদি। এছাড়াও বখতিয়ারের আক্রমনে দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বের অংশ হিসেবে মালদা সংযুক্ত হয়, তার প্রমাণ স্বরুপ রয়েছে মালদার ফিরোজ মিনার যেটি তৈরি করেন সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ।
পরবর্তীতে মুঘল রাজারা প্রায় গোটা ভারতব্যাপী রাজত্ব কায়েম করলে মালদা তার অংশ হয় এবং মালদাতে শাহ সুজা দাখিল দারয়াজা তৈরি করেন।
প্রারম্ভিক আধুনিক সময়ের মালদা:
ষোড়শ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের দূর্বলতার সুযোগে বাংলার নবাব শক্তিশালী হয়ে উঠে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন মুর্শিদকুলি খান, যিনি মুর্শিদাবাদ শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং এটিকে তার রাজধানী করেছিলেন। কিন্তু মালদার প্রতি তার আনুগত্য ধরে রেখেছিলেন।
ঔপনিবেশিক সময়কাল থেকে স্বাধীনতা
১৮৫৭ সালে ইংরেজদের সাথে সিরাজদ্দৌলার পলাশীর যুদ্ধের পর মালদা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। মালদা ছিল ইংরেজদের প্রথম পছন্দ তাই ইংরেজরা তাদের প্রশাসনিক সদর দফতর সেই সময় মালদাতে নির্মাণ করেন, সেই স্থান বর্তমানে ইংরেজবাজার নামে পরিচিত, এমনকি তারা মালদায় একটি কোষাগার ও আদালতও খোলেন। কিন্তু বাংলার বিপ্লব থেকে কিছুটা রেহাই পেতে এবং প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে বাংলাকে কয়েকটি জেলা ও মহকুমায় বিভক্ত করে। যার ফলে মালদা প্রথমে দিনাজপুর জেলার অংশ তারপর পূর্ণিয়া জেলা, তারপর রাজশাহী বিভাগের সাথে যুক্ত হয়, কিন্তু ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর, মালদা ভারতের সংযুক্ত হয়, এবং স্বাধীনতার পর মালদা আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৮১ সালে একটি পৃথক জেলা হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০২৩
কোলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল ঘুরে আসুন।। Visiting Kolkata Victoria Memorial hall।।
ছোটোবেলা থেকেই জন্মেছিল সেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখার প্রত্যাশা। কোলকাতা গিয়েছি অনেকবার কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠেনি একবারও। এবার যেহেতু সুযোগ পেয়েছি তাই ছাড়ার কোনো ইচ্ছে নেই। হেঁটে হেঁটেই স্মৃতি বিজড়িত স্থানের দিকে রওনা দিলাম।
পরপর দুই বছরের দুটি যুদ্ধ ১৮৫৭ সালে পলাশীর, এবং ১৮৫৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহ হলে ব্রিটিশ সরকারের মনে হয় ভারতের মত এত বড় দেশকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাষনের মধ্যে না রাখাই উচিত, বরং ব্রিটিশ সরকার নিজেই সেই শাষনভার গ্রহন করুক। এই সুবাদেই রানি ভিক্টোরিয়া ১৮৭৬ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত ভারত শাসন করেছিলেন। এখানে একটি বিষয় জানা উচিত- অনেকেরই মনে হয় রানি ভিক্টোরিয়া, কোলকাতার এই মেমোরিয়াল থাকতেন এবং এখানে থেকেই তিনি তার শাসন চালাতেন। কিন্তু বাস্তবে রানি ভিক্টোরিয়া একবারও ভারতে আসেন নি।
কোলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে আমি |
ভারত শাসনকালেই ইংল্যান্ডেই রানীর মৃত্যু হলে, তার পরবর্তী সময়ে রানি ভিক্টোরিয়ার স্মরণে একটি স্মারক নির্মাণের ধারণা প্রকাশ করেন তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন। এই কাজে তিনি সেই সময়ের বিখ্যাত আর্কিটেক্ট উইলিয়াম এমারসন কে দায়িত্ব দেন এবং তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন ভিনসেট এস। তাদের একান্ত তত্ত্বাবধানে শ্বেত মার্বেল দিয়ে ১৯০৬ সালে এই মেমোরিয়ালের নির্মাণ শুরু হয় এবং সমস্ত কাজ শেষ হয় ১৯২১ সালে। আবার এই বছরেই এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
কি কি রয়েছে এখানে
দেখার জন্য এখানে অনেক কিছু রয়েছে, বিশেষ করে স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্পর্কিত বস্তু।
বর্তমানে মেমোরিয়ালটি একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যাতে ৫০,০০০ টিরও বেশি আইটেমের সংগ্রহ রয়েছে, যেমন চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ছবি, হাতে লেখা গ্রহণপত্র, টাকা, টেকসটাইল এবং ভারতের ইতিহাস এবং শিল্পের সম্পর্কিত আরও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। ভারতের কয়েকজন শাষনকর্তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র, বিখ্যাত লোকেদের চিত্রকলা এছাড়াও আরো বহু কিছু (সব বলছিনা, আমি চাই আপনারা এগুলো নিজে স্বচক্ষে দেখুন।)। এছাড়াও মেমোরিয়ালটিতে মন ভালো করার মত ৬৪ একরের একটি বাগান রয়েছে।
যেতে চাইলে যেতে পারেন কোলকাতার খুব একটা দূরে না। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সকাল দশটায় খোলে এবং সারাদিন সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকার পর সন্ধ্যা ছয়টায় বন্ধ করে দেয়া হয়। ভারতীয়দের প্রবেশমূল্য জনপ্রতি তিরিশ টাকা।
কিভাবে যাবেন
আপনি উত্তরবঙ্গ থেকে কোলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখার জন্য বিভিন্ন উপায়ে যেতে পারেন। আমি আপনাকে কিছু সুবিধাজনক ও সস্তা উপায় বলে দিচ্ছি
রেল: আপনি উত্তরবঙ্গের যে কোনো রেলওয়ে স্টেশন থেকে কোলকাতা (শিয়ালদা, হাওড়া, কোলকাতা) এর দিকে রেলের টিকিট কাটিয়ে নিতে পারেন। এবং সেখান থেকে বাসে চেপে যেতে পারেন।
রোড: আপনি উত্তরবঙ্গের যে কোনো বাস-স্ট্যান্ড (শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালদা) থেকে কোলকাতা ধর্মতলা গিয়ে সেখান থেকে খুব কাছে আপনারা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পেয়ে যাবেন , ধর্মতলা থেকে চাইলে আপনি বাসে করেও মেতে পারেন।
আকাশপথে: শিলিগুড়ি বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে কোলকাতা দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছে আপনি বাসে ধর্মতলা গিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল মেতে পারেন। অথবা দমদম এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি অথবা ক্যাব ভাড়া করে সরাসরি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঘুরে আসতে পারেন।
মনে রাখবেন, ধর্মতলা থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল যেতে গেলে আপনাকে ৭ নম্বর বাসে চেপে বসতে হবে।
শনিবার, ২৭ মে, ২০২৩
"বঙ্গাব্দ" প্রচলনের ইতিহাস ।। HISTORY OF BANGLA CALENDAR BONGABDO.
পহেলা বৈশাখের প্রবর্তক আকবর |
বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০
বাংলা বানানের জটিলতা তার সংস্কার ।। BANGLA SPELLING HISTORY ||
এ যেন এক অদ্ভুত বাংলা, বাংলার বাঙ্গালি এত দিন ইংরাজি জানতো এবং প্রয়োজন বোধেই তার ব্যবহার করতো, কিন্তু বর্তমানের বাঙ্গালি যেন ইংরাজি জানছে না, বরং গ্রহন করছে। তাই, বাংলা ভাষা যেন আর বাংলার গর্ব আর তেমন মনে হয় না। বাংলা আর ইংরাজির মিশ্রিত রুপ যেন বেঙ্গলিশ, উদাহরণ রয়েছে প্রচুর, যদিও বর্তমানে বিজ্ঞানের আশির্বাদে বেশির ভাগ নবাগত বস্তুর বাংলা অর্থ হয় না, কিন্তু যে জিনিসগুলোর বাংলা রয়েছে সেগুলোর মর্যাদা দেওয়া অবশ্যক। বাংলার বাঙ্গালিদের কাছে "নদি" নাকি "নদী" , "কাহিনি" নাকি "কাহিনী", "প্রতিযোগিতা" নাকি "প্রতিযোগীতা" কোনটা সঠিক বানান সেটা নিয়েই ধন্দে পরে যাই, আর এমনটাই স্বাভাবিক, বর্ণমালাই "৯" তার অস্তিত্ব হারিয়েছে বহুআগেই ,কিন্তু পাঠ্য পুস্তকে জায়গা করে রেখেছে এখনো। তাহলে কি বাংলা বানানের মান্যী রুপ আসবে না কখনো?
বাংলা বানানের বিবিধ সমস্যা |
বানান সংস্কারে রবীন্দ্রনাথ
মান্যী রুপ আসবে, এমন নই যে আসবে না। পরিবর্তন বাংলা ভাষাতে যেমন রয়েছে তেমনি পরিবর্তিত বাংলা উচ্চারণকে সামনে রেখেই বাংলা বানানের সংস্কার প্রদানের চেষ্টা চলে আসছে আগে থেকেই, উদ্দেশ্য একটাই বাংলা ভাষার সরলিকরণ। বাংলা ভাষাকে যিনি বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছিলেন যিনি, সেই বিশ্বগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা বানানের শুদ্ধ রুপ প্রদানে এগিয়ে আসেন প্রথম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব জয়ের পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যাল থেকে তাকে আংশিক অধ্যাপকের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় বাংলা বিভাগের জন্য ১৯৩২ সালে।
আরো পড়ুন = নকল ইলিশ মাছ থেকে সাবধান।
তখন তিনি বাংলা বানানের সংস্কার প্রয়োজন মনে করেন এবং বানান সংস্কারকে চুড়ান্ত রুপ দিতে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি সুপারিশ প্রদান করেন, এবং সেই সময় ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (তখনো উপাচার্য হন নি) সেই প্রস্তাবে সারা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই তার দায়িত্ব ভার তুলে দেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন মাত্র দুই বছরের জন্য।
বাংলা বানান সংস্কার সমিতি
১৯৩২-৩৪ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অধ্যাপক রুপে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যাবার পরেই ১৯৩৫ সালে বাংলা বানানের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই রাজশেখর বসুর সভাপতিত্বে "কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানান সংস্কার সমিতি" গঠন করা হয়, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বংলা বানানের শুদ্ধতা প্রদান আর বাংলা ভাষার সরলিকরণ।
বাংলা লেখা বাস্তবেই জটিল |
পরিবর্তীকালে বাংলা বানানের ক্ষেত্রে তেমন বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি, কিন্তু ১৯৮১ সালে অধ্যাপক বিজন কুমার বন্দোপাধ্যায় সভাপতি হয়ে এলে বানান সংস্কারের কিছু বেগ পাই।
বাংলা আকাদেমি
এই সময়ের কিছু পর থেকেই নব কবিরা, তাদের লেখনশৈলির সঠিক বানানের প্রয়োজনিয়তা মনে করে, ফলে বাংলা আকাদেমি বাংলা বানানের শুদ্ধিকরণের জন্য রুচিবোধ প্রকাশ করে। বাংলা ভাষার সমতা বিধান, লেখনশৈলী ও বাংলা বানানের সরলিকরণের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমি ১৯৯৫ সালে তাদের সুপারিশ পত্র প্রকাশ করে এবং সেই বছরি শেষের দিকে সেই সুপারিশের উপর ভিত্তি করে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জ্ঞানি গুনি ব্যাক্তিদের নিয়ে একটি বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়, এবং সেই আলোচনার সাপেক্ষে গৃহিত সিদ্ধান্ত ও বাংলা বানানের নিয়ম হিসাবে একটি পুস্তিকা পরের বছর বের করা হয়, যার নিয়ম অনুসারে বর্তমান বাংলা বানান নির্ধারিত হয়েছে, যেমন "নদী" শব্দটি পরিনত হয়ে সঠিক শব্দ হিসাবে বিবেচীত হয়েছে "নদি" তে, তেমনি ইরানী হয়েছে ইরানি ,কোষ হয়েছে কোশ, জাপানী বানান পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে জাপানি।
তবে গৃহিত সিদ্ধান্তে আরো বলা হয়েছে যে সময়ের সাথে মানুষের উচ্চারণ পরিবর্তনের সাথে সাথে বানানের রিতিও পরিবর্তন হতে পারে।
এছাড়াও কিছু বাংলা বানানের কিছু নিয়ম রয়েছে যা বিস্তর আলোচনা ও ব্যাকরণ যুক্ত, যেমন- মন্ত্রী শব্দটি সঠিক কিন্তু মন্ত্রীপরিষদ শব্দটি সঠিক নই, সঠিক বানান মন্ত্রিপরিষদ, ঠিক একি ভাবে প্রাণিবিদ্যা, গুনিজন ইত্যাদি ইত্যাদি।
রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০
দূৰ্গা যেখানে নিন্দিত অসুর যেখানে পূজিত || অসুর পূজা ও আদিবাসী সমাজ || story of asur or hudur durga puja dasai dance and tribe ||
শরৎের আকাশ আর কাশফুল দেবী আগমনের বার্তাবাহক। একদিকে যখন ঢাঁকিরা এই করোনাময় পরিস্থিতীতে যৎসামান্য উপার্জনের আশাই তাদের ঢাঁকে রশি কশছে, অপরদিকে সাঁওতাল পাড়ার দাঁশাই শিল্পীরা তাদের ধাঁমসা মাদলের রশি কশছে শহরতলিতে গিয়ে খানিক উপার্জনের আশাই। শারদীয়ার সমাবেশে ঢাঁকি আর দাঁশাই নৃত্য শিল্পীদের বাস্তবিক মেল বন্ধন, আলাদা আলাদা আক্ষরিক অর্থ বহন করে, একপক্ষ দেবী বন্দনাই তার ঢাঁকের তাল তোলে আর একপক্ষ দেবী নিন্দাই ধাঁমসাই তাল তোলে, সাথে মৌখিক বোল - "হাইরে হাইরে!"
দাঁসাই নৃত্যের এই বোল অসুর নিধনের প্রতি সমবেদনা ব্যক্ত করে, আর্য রমনির হাতে বীর শহীদ অসুরের নিধন। আজো পশ্চিমবঙ্গের অনেক আদিবাসী অধ্যূষিত এলাকাই দেবী দূৰ্গার নই বরং অসুরের পূজা করা হয়। ভারতে অসুর বন্দনা ও দূৰ্গাকে হত্যাকারিনি পতিতা হিসাবে উল্লৈখ্যকরণ সকল মানুষের চোখে প্রথম আসে যখন জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘অল ইন্ডিয়া ব্যাকওয়ার্ড স্টুডেন্টস ফেডারেশন” “মহিষাসুর শহীদ উৎসব” পালন করা শুরু করে এবং সেই উৎসবের প্রচারে প্রচারপত্র বের করে, যেখানে দূৰ্গাকে পতিতা (বেশ্যা) এবং অসুরকে মহান অনার্য রাজা হিসাবে অভিহিত করা হয়, যা তৎকালিন শিক্ষামন্ত্রী মাননীয়া স্মৃতি ইরাণী পার্লামেন্টের অধিবেশনে প্রবল ভাবে বিরোধ করে।
দূৰ্গা পূজা দূৰ্গা প্রতিমা |
অসুর পূজা কারা করে
আদিবাসী খেড়ওয়াল জনজাতির প্রধানত অসুর, সাঁওতাল, মাহালী,মুন্ডা,কোল, কুর্মি (তপশিলী উপজাতির মর্যাদা এখনো পাইনি) আদিবাসীরা বাংলার বহু স্থানে অসুর পূজা করে থাকেন। তার মধ্যে দুই দিনাজপুর, জলপাইগুড়ী, কোচবিহার, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম আরো বহু জেলাই। তাদের মতে দূৰ্গা পূজো ব্রাহ্মন্যবাদের তৈরি স্বকীয় অনুষ্ঠান, যার পিছনে রয়েছে অনার্যদের পরাজয়ের অশেষ চাতুরতা ও ব্রাহ্মন্যবাদ প্রচারের কার্যকলাপ এবং আর্য ও অনার্য সংঘাতের স্মৃতি। তাদের মতে দূৰ্গা কোনো নারির নাম নই বরং পুরুষের নাম, আর যে পুরুষ ছিলেন অসুর জাতির রাজা হুদূরদূৰ্গা, আদিবাসী অনার্য রাজা, সেই রাজাকে হত্যা করেই পতিতা নারি দূর্গা নাম অর্জন করে। আশ্চর্যজনকভাবে ভারতে খেড়ওয়াল জাতির মধ্যে এখনো অনেকের অসুর জাতিদের অসুর পদবী দেখা যায়।
মহিষাষুর বধ নাকি হুদূর দূৰ্গা হত্যা? |
অসুর
"অসুর" শব্দটি ভগবান বিরোধি, অপশক্তি, মানব বিরোধি ভীমকায় শরিরের অধিকারি আক্ষরিক অর্থ বহন করে, কিন্তু খোদ হিন্দু শাস্ত্রগুলোই অসুরদের নিন্দাসূচক হিসাবে ব্যক্ত করেনি বরং হিন্দুদের সর্বোচ্চ শাস্ত্র বেদে দেবতাদেরো অসুর উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে, যেমন- মরুৎকে মারুতাসুর ( ঋগ্বেদ ৬৪/২), রুদ্রকে রুদ্রাসুর(ঋগ্বেদ ৫/৪২/২১), ইন্দ্রকে ইন্দ্রাসুর(ঋগ্বেদ ৫৪/৩), বরুণকে বরুনাসুর(ঋগ্বেদ ২/২৭/১০), অগ্নিকে অগ্নিসুর(ঋগ্বেদ ৫/১২/১)। বেদের একটি শ্লোকে আবার অসুরকে প্রানদান কারি বলা হয়েছে - অসুন্ প্রাণান রাতি দদাতি ইত্যসুরঃ।
সংস্কৃত শব্দ "অস" লোহা, তবে "সুর" শব্দ বিবিধ অর্থ বহন করে -ধ্বনি, নেশা জাতীয় পানিয়, নিশ্বাসের বায়ু প্রভৃতি। সম্ভবতঃ আর্য ও অনার্যদের মাঝে দীর্ঘ-সংঘাত অসুর শব্দটিকে নেতিবাচক করে তুলেছে। আদিবাসী খেড়ওয়াল জাতির অসুরেরা যে প্রাচীন ভারতের প্রজাহৈতষী রাজা ছিলেন তার বিষয়ে বহুল প্রমানাদি পাওয়া গেছে, এবং আর্যদের জয়ে ও অনার্যদের পরাজয়ে আজ আদিবাসীরাই ভূমিহিন। এই প্রসঙ্গে দাড়ি দিয়ে অনেকেই মনে করেন ব্যাবিলনের শাষক অসুরসিরিপাল, অসুরবনিপাল অসুর জাতিরি অংশ যারা আর্যদের কাছে পরাজিত হয়ে ব্যাবিলনে চলে যান এবং সেখানে অসুর বা আসীরিয়া নামক সাম্রাজ্যের স্থাপন করেন, যার রাজধানীর নাম ছিল অস্মুর। কিন্তু অনেকেই এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। যাই হোক ভারতে পরাজিত অনার্য আদিবাসী অসুর উপজাতিরা বংশ পরম্পরাই দূৰ্গা পূজাকে বয়কট করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে যাদের বাস পশ্চিমবঙ্গ,ঝাড়খন্ড ও বিহারের কিছু কিছু স্থানে।
খেড়ওয়াল হুদূর দূৰ্গা হত্যার কাহিনী।
খেড়ওয়াল আদিবাসী গোষ্ঠিগুলোর মধ্যে অসভ্য,বর্বর আর্যজাতিদের দ্বারা সরল অথচ শক্তিশালী অনার্যদের পরাজয়ের ও আদিবাসী রাজা হুদূর দূৰ্গার হত্যালিলার কাহিনী এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্ম চলে আসছে। হুদূর দূৰ্গার এই কাহিনীর লিখিত উপাদান নাই, তথাপি লোককাহিনী অনুসারে প্রচলিত, তবে এর সত্যতার প্রতিউত্তর রয়েছে, খেড়ওয়াল বীদ্বজনেরা যুক্তি প্রদানে এগিয়ে এসে বলেন, হিন্দু ধর্মের মহান পবিত্র ধর্মগ্রন্থ "বেদ" , যেটি একসময় বংশপরম্পরাই শুনে আসা শ্লোকের সত্যতা যাচাই ছাড়া বেদে রুপান্তরিত করে সেটি সর্বসম্মত বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যদিও বা আদিবাসী অনার্য রাজা হুদূর দূৰ্গার লিখিত গ্রন্থ থেকে থাকতো তবে তা ব্রাহ্মন্যবাদের হঠকারিতাই ধ্বংস্ব করা হয়েছে।
আরো পড়ুন- বোকা আদিবাসী এবার একটু চালাক হও, সময় হয়েছে পরিবর্তনের।
তাহলে কেমন সেই কাহিনী- আর্য আগমনের পরবর্তিকালে অনার্য এবং আর্যের চড়ম সংঘাত ঘটে, কিন্তু শারীরিক শক্তিতে শক্তিশালী অনার্যদের পরাজিত করা আর্যদের সম্ভবপর হয়ে উঠছিল না। হিন্দু বেদের এক জায়গাই অসুর শব্দের অর্থ ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপে পটু জাতি হিসাবে বর্ণিত করা হয়েছে, যেটি অনার্য খেড়ওয়াল জনজাতির যুদ্ধ পারদর্শিতারই ইঙ্গিত দেই। অনার্য আদিবাসী অসুর জনজাতির রাজা হুদূর দূৰ্গা নিজ মাতৃভূমি চাইচম্পা রক্ষার্থে বদ্ধ পরিকর। শারীরিক ক্ষমতাই অনার্যদের পরাস্ত করা কোনোমতেই সহজসাধ্য হয়ে উঠবে না আর্যদের পক্ষে, সুতরাং ছলচাতুরির দ্বারা অসুর আদিবাসী সম্প্রদায়ের রাজা হুদূর দূৰ্গাকে পরাস্থ করার যোযনা করে।
অসুর পূজা |
অসুর আদিবাসী সম্প্রদায়েরা নারি সম্মানে অগ্রসর ও নারির উপরে হাত তোলাও কাপুরুষের নামান্তর মনে করতো। সুতরাং নারীই হয়ে উঠলো অসুর জনজাতির রাজা হুদূর দূৰ্গাকে পরাস্ত করার কান্ডারি। আর্য এবং অনার্যদের যুদ্ধে আর্যরা পরাজিত হয়ে হুদূর দূৰ্গার সাথে মিথ্যা মিত্রতার হাত বাড়ীয়ে দেই এবং উপহার স্বরুপ অপূৰ্ব সুন্দরী এক পতিতা (বেশ্যা) নারীকে হুদূর দূৰ্গার সেবার্থে প্রদান করে। এই লাস্যময়ী ছলা-কলাই পারদর্শী এই পতিতা নারী শীঘ্রই আদিবাসী অসুর জনজাতির রাজা হুদূর দূৰ্গাকে নিজের প্রেম বন্ধনে আবদ্ধ করে নেই এবং শীঘ্রই রাজা হুদূর দূৰ্গা সেই নারীকেই বিবাহ করেন। একদিন রাত্রীকালিন খেড়ওয়াল অসুর আদিবাসী সম্প্রদায়ের রাজা হুদূর দূৰ্গাকে হত্যা করার সুযোগ পেয়ে সেই নারী রাজা হুদূর দূৰ্গাকে হত্যা করে, যেই মহূৰ্তে প্রাসাদের বাকি অসুর সম্প্রদায়ের পুরুষেরা নিজের প্রান বাঁচাতে নারীর ছদ্মবেশ ধারন করে পালিয়ে যাই, যেই ঘটনাটিকে সামনে রেখেই দূৰ্গা পূজা চলা কালিন দাঁসাই নৃত্যে পুরুষেরা নারী পরিধান ব্যবহার করে।
দাঁসাই নাচ
সেই পতিতা নারীর চক্রান্তে রাজা হুদূর দূৰ্গা মারা যাই, এবং দূৰ্গা হত্যাকারিনী বির হিসাবে আর্যরা সেই পতিতা নারীকেই দূৰ্গা উপাধিতে অভিষিক্ত করে। যে ঘটনাটি আদিবাসী সাঁওতাল জনজাতির বংশপরম্পরাই চলে আসা বিভিন্ন গানের দ্বারা মানুষদের জানিয়ে থাকে। খেড়ওয়াল আদিবাসী জনজাতীর মধ্যে একটি সাঁওতাল, যারা দূৰ্গা পূজার সেই মহূৰ্তে পাড়াই পাড়াই গিয়ে দাঁসাই নাচ আর গানে তাদের বীর যোদ্ধা হুদূর দূৰ্গার বীরগাঁথা সকলের সামনে প্রস্তুত করে।
"দাঁসাই" প্রথম থেকেই আদিবাসীদের দুঃখ প্রকাশের অনুষ্ঠান ছিল না, বছরের অন্যসময়েও এই নৃত্য নাচা হয়, কিন্তু সেখানে খেড়ওয়াল বীরগাঁথা অংশ পাই না, বরং আনন্দই স্থান পাই। দাঁসাই প্রধানত পুরুষদের দ্বারাই পরিবেশিত হয়, দূৰ্গা পূজাই দাঁসাই নৃত্যে পুরুষেরা ধামসা,মাদল,করতাল সহযোগে এছাড়াও লাঁও এর খোলস এবং ধনুকের ছিলা দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় যা প্রতিকী স্বরুপ, এইসময় সাঁওতাল আদিবাসী পুরুষেরা ময়ূরের পাখনা মাথাই গুঁজে, সিন্দুর, ও কাজল দিয়ে নারীসুলভ রুপ ধারন করে।
নীতিহীন যুদ্ধে আর্যদের পরাস্ত করে আর্যাবর্ত নামে আর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আর্যপক্ষ যখন সেই পতিতা নারীকে দূৰ্গা উপাধি দিয়ে বিজয় উৎসবে মেতে উঠেছিল সেই সময় সাঁওতাল, মুণ্ডা, কোল, কুরমি, মাহালি, কোড়া-সহ খেরওয়াল গোষ্ঠীর আদিবাসীরা তাঁদের বশ্যতা স্বীকার না করে নিজেদের মান বাঁচানোর উদ্দেশ্যে নারীর ছদ্মবেশে দাঁশাই নাচের মাধ্যমে আধ্যাত্তিক বেদনা নিয়ে আনন্দের অভিনয় করতে করতে স্বভূমি চাইচম্পা ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। যেই চিত্রনাট্য দাঁসাই নাচেই ফুঁটে উঠে।
দাঁসাই নাচ (ছবি ইউটিউব গ্রেবশট) |
সুতরাং ভারতীয় সংস্কৃতিতে যে দেবাসুরের সংগ্রামের কথা পাই, সেটা বাস্তবে শক্তির সঙ্গে প্রজ্ঞার লড়াই ছিল, যেখানে ছলচাতুরিতে পারদর্শী আর্যরা জয় লাভ করে ছিল, আর অনার্যরা পরাজিত হয়ে স্বভূমি ত্যাগ করে।
অসুর পূজার অনুষ্ঠান পর্ব
সাঁওতালি দাঁশাইয়ের বিধি অনুযায়ী, দূৰ্গা পূজোর পাঁচদিন দেবী দুর্গার মুখ দর্শন বন্ধ থাকে। তবে অসুর পূজার আয়োজন শুরু হয় মহালয়ার পর্ব থেকেই, যেদিন খেড়ওয়াল আদিবাসীরা শহিদ দিবস হিসাবে পালন করে থাকে। বেদের বেশীর ভাগ অংশেই অসুরদের শুভশক্তির উৎস হিসাবেই দেখিয়েছে, কিন্তু কালক্রমে অনার্য আর আর্যদের মাঝে বিশৃঙ্খলা অসুরদের জনবিরোধি প্রতিচ্ছবি করে তুলে, অসুরাঃ রাক্ষসাঃ দেবনিন্দকাঃ শ্লোকটি তার সত্যতা তুলে ধরে। যাইহোক, এইসময় অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী শোকপালন করতে গিয়ে ওই দিনগুলিতে বাড়ি থেকে বের হন না, কেন না ভূমিপুত্র আদিবাসী খেড়ওয়ালরা তাদের পূৰ্ব গৌরব আর ক্ষমতা হারায়, যে দুঃখ আজও তারা মেনে নিতে পারেননা। হুদূর দূৰ্গা হত্যার দিন চলে তার বীরত্বের জয়গাঁথা ও স্মরনসভা যেটি দাশানি বলে পরিচীত, ব্রাহ্মন্যবাদের সেই হঠকারিতাই এই দাঁশানিই হয়ে উঠেছে বিজয়া দশমী। পূজার পনেরো দিন পরেই অধিবাসীদের দ্বারা পালিত বাঁদনা পরবে গৃহপালিত পশু হিসেবে মহিষের পুজো করা হয়।
আরো পড়ুন- ভাষা হারানোর ভয়ে মাহালী আদিবাসী সমাজ।
ভূমিপূত্রদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করা আর্যরা দূৰ্গা পূজাই আত্মহারা, অপরদিকে অসুর আদিবাসীরা দুঃখের সাথে দিনকাটাই, অসুর পূজা ইদানিংকালে বেশ বড় মাপের করা হয়। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী মাননীয়া স্মৃতি ইরানি আদিবাসী ছাত্রদলের অসুর শহীদ স্বরণ দিবসকে অশুভ শক্তির প্রসারের নাম দিয়ে বলেন যে এতে হিন্দুদের আস্থায় আঘাত হানছে, তিনি সঠিকই বলেছেন কিন্তু এই যুক্তির খন্ডন সহজ, আদিবাসী সমাজের যারা অসুরকে পূৰ্বপুরুষ হিসাবে জেনে আসছে তাদের কাছে তবে দূৰ্গা পূজাও তাদের পূৰ্বপুরুষদের প্রতি অসম্মানের প্রতিক হিসাবে মনে করবে। এই প্রসঙ্গে বামপন্থি নেতা মাননীয় সিতারাম ইয়েচুরি আদিবাসী ছাত্রদলের পক্ষ নিয়ে পার্লামেন্ট অধিবেশনে যুক্তি দেখান। ভারত বৈচিত্রে ভরপুর সুতরাং একে অপরের প্রতি আস্থা রেখে নিজেদের বিশ্বাস আর সংস্কৃতি জিইয়ে রাখতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রির ভাষাই - ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।
সুমন্ত মাহালী হেমরম
রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০
গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম নির্বান || gautam buddha and buddhism nirvana ||
গৌতম বুদ্ধ বিশ্বে অন্যতম প্রচারিত বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক, যে ধর্ম আজ চিন, মালেশিয়া,জাপান, থাইল্যান্ড এছাড়া আরো বহু দেশের মানুষেরা বহুল সংখ্যক হারে অনুসরণ করে চলেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের এই মহান প্রবর্তক ভগবান গৌতম বুদ্ধ আদতে ভারতেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ৫৬৬ খ্রীষ্ট পূৰ্বাব্দে (অনেকের মতে ৫৬৩)। যাই হোক গৌতম বুদ্ধ যখন জন্মগ্রহন করেন তখন ভারত মনুবাদী সমাজ ব্যবস্থায় জর্জরিত ছিল। অনেকে আবার ভগবান মহাবীরের সাথে গৌতম বুদ্ধকে গুলিয়ে দেন। অবশ্য এমন হওয়াটা অনেকটাই স্বাভাবিক, কারন এই দুই মহান মহা পুরুষ একই সময় কালে এবং প্রায় একই রকম মতবাদ প্রচার করেন। তাই এই দুই মহাপুরুষের মাঝের অন্তরাই সঠিক ভাবে গোচরে আনা প্রয়োজন।
গৌতম বুদ্ধের তপস্যা |
গৌতম বুদ্ধের পূৰ্ব জীবন
গৌতম বুদ্ধের জন্মের সময়কাল হিসাবে অনেকেই ভিন্ন মত পোষন করেছেন। গৌতম বুদ্ধের জন্ম বিষয়ক তথ্য সমূহ মহাবংশ, দ্বীপবংশ, সুত্ত্বনিপাত, ললিত বিস্তার, এছাড়াও অশ্বঘোষ রচিত "বুদ্ধচরিত" গ্রন্থ থেকে পাওয়া যাই। গৌতম বুদ্ধ বর্তমান নেপালের তৎকালিন কপিলাবস্তুর লুম্বিনী নামের একটি স্থানে জন্মগ্রহন করেন। গৌতম বুদ্ধের পিতা ছিলেন লুম্বিনির রাজা, যার নাম ছিল শুদ্বোধন এবং তার মা ছিলেন দেবদাহ রাজ্যের রাজকন্যা মায়া।
জন্ম হবার পর প্রথম দিকে গৌতম বুদ্ধের নাম ছিল সিদ্ধার্থ, কিন্তু কথিত আছে যে অসিত নামের একজন সন্যাসি নবজাত শিশুকে দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে এই শিশু পরবর্তীকালে একজন রাজচক্রবর্তী অথবা একজন সিদ্ধ সাধক হবেন, এছাড়াও এক ব্রাহ্মণ যার নাম ছিল কৌণ্ডিন্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, এই শিশু পরবর্তীকালে বুদ্ধত্ব লাভ করবেন। কিন্তু হঠাৎ তার মা মায়াদেবি মারা গেলে শিশু সিদ্ধার্থের মানুষ করার দায়িত্ব চলে আসে সিদ্ধার্থের সৎ মা প্রজাপতি গৌতমীর উপর, যার মাতৃছায়াই সিদ্ধার্থ বড় হন, যেহেতু তাকে লালন পালন তার বিমাতা গৌতমী করেছিল, তাই সিদ্ধার্থের পরবর্তিকালে নাম পরে যাই গৌতম।
বৌদ্ধত্ব লাভ
গৌতম বৌদ্ধ সন্যাস জীবন গ্রহন করার আগে আলার কলাম নামে একজনের কাছে দিক্ষা নেন। কিন্তু তার বহু আগে বাল্যকাল থেকেই সিদ্ধার্থের মধ্যে সংসারের প্রতি মায়া একপ্রকার ম্লান হয়ে পরে। এমনাবস্থাই সিদ্ধার্থের পিতা শুদ্বোধন গৌতমের সংসারের প্রতি এই অনিহা দেখে গৌতমকে বাল্যকালেই শাক্য রাজ্যের রাজকুমারি গোপা বা যশোধরার সাথে বিয়ে দিয়ে দেন।
গৌতম বুদ্ধের রাজকুমারি গোপার সাথে বিয়ে হলে তাদের একটি পুত্র সন্তান হয়, যার নাম তারা রাখেন রাহুল, কিন্তু তবুও গৌতম বুদ্ধের মন পার্থিব এই সংসারের মোহ-মায়াই আকৃষ্ট করতে পারে নি, গৌতম বুদ্ধ বরাবরই মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া সুখ ও দুঃখের নিবৃত্তির জন্য মধ্য পন্থা খুঁজতেন। একদিন রাত্রে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য গৌতম বুদ্ধ ঘর থেকে পালিয়ে যান। যেটি বৌদ্ধ ধর্ম অবলম্বনকারিদের কাছে ও ইতিহাসের পাতায় "মহাভিনিষ্ক্রমণ" নামে পরিচিত।
সংসারের মোহ-মায়া ত্যাগ করার পর গৌতমবুদ্ধ বুদ্ধগয়ার কাছে ফল্গু নদির পাশে থাকা অশ্বথ গাছের নিচে তপস্যায় লিন হন, এবং দীর্ঘদিন তপস্যাই লিন থাকার পরেও তিনি প্রথম তপস্যার পর্যায়ে সফল হতে পারেন নি, কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি সুজাতা নামের একজন মহিলার পায়েস খাবার পর এই সিদ্ধান্ত নিলেন যে যতক্ষন না তিনি বোধি বা পূৰ্নজ্ঞান অর্জন করছেন না ততক্ষন তিনি তপস্যা থেকে উঠবেন না। সিদ্ধার্থের দ্বিতীয় প্রচেষ্টাই তিনি সফল হলেন এবং বোধি বা দিব্যজ্ঞান লাভ করলেন, যে থেকে তার নামের সাথে "বুদ্ধ" বা পরমজ্ঞানী, এবং "তথাগত" নামে পরিচিত হলেন।
বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার
বোধি লাভের পর সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ নামে পরিচিত হলেন, এবং যে গাছের নিচে তিনি এই বোধি লাভ করেছিলেন সেই উদ্ভিদ বোধিবৃক্ষ নামে পরিচিত। গৌতম বুদ্ধ অসিম জ্ঞান অর্জনের পর তার মতবাদ প্রচার করতে তিনি বারানসির ঋষিপত্তন নামের স্থানে যান (বর্তমান নাম সারনাথ)। সেখানে গিয়ে মৃগশিখা বনে তার প্রথম ধর্মপ্রচার করেন এবং সেই বনেই তার কাছ থেকে প্রথম দিক্ষা নেন বপ্য, ভদ্রিয়, অশ্বজিত প্রমূখেরা। যেই ঘটনাটিকে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারিরা "ধর্মচক্রপ্রবর্তন" হিসাবে উল্লেখ করে থাকেন।
ধর্মচক্রপ্রবর্তন |
ভগবান গৌতম বুদ্ধ দুঃখ থেকে নিবৃত্তি পাওয়ার জন্য চারটি আর্যসত্য এর কথা বলেছেন, যেগুলো হল- দুঃখের অস্তিত্ব আছে, দুঃখের কারন আছে, দুঃখের নিবৃত্তি করা সম্ভব এবং নিবৃত্তি করার উপাই রয়েছে, আর এই নিবৃত্তি পাওয়ার অন্তরাই কে নির্বান বলা হয়।
এছাড়াও গৌতম বুদ্ধ নির্বান লাভের জন্য আটটি প্রধান পন্থার কথা বলেন, যেগুলো অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে পরিচিত। গৌতম বুদেধের দ্বারা প্রচারিত ধর্মমতে সেই সময়ে রাজা মহারাজারাও আকৃষ্ট হয়ে গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম গ্রহন করেছিলেন। যারা হলেন সম্রাট অশোক, কনিষ্ক, বিম্বিসার,প্রসেনজিৎ ইত্যাদি।
গৌতম বুদ্ধের মৃত্য ও পরবর্তি ধর্ম প্রচার
গৌতম বুদ্ধ মাত্র ৮০ বছর বয়সে তৎকালিন মল্ল রাজ্যের রাজধানি কুশিনগরে প্রান ত্যাগ করেন, যেই ঘটনাটিকে বুদ্ধিষ্টরা "মহাপরিনির্বান" নামে ডেকে থাকেন। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যর পর তার প্রচারিত ধর্মমত খুব দ্রত হারে গোটা ভারতে ছড়াতে থাকে, এবং পরবর্তি কালে হীনযান ও মহাযান নামে দুটি শ্রেনির উদ্ভব হয়। ভগবান গৌতম বুদ্ধের মৃত্যর পর তার প্রচারিত ধর্মমতকে আরো কার্যকরি করার উদ্দেশ্যে সেই সময়ে কিছু রাজার গৃষ্ঠপোষকতাই চারটি বৌদ্ধ সংগতিও হয়েছিল, যার মধ্যে প্রথম অজাতশত্রুর পৃষ্ঠোপোষকতাই ও মহাকশ্যপের সভাপতিত্বে রাজগৃহের সপ্তপর্ণী গুহায় সংগঠিত হয়েছিল, যেই সংগতিতে পালি ভাষায় ত্রিপিটক রচনা করা হয়,যা আজ বৌদ্ধদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় সম্মেলন হয় রাজা কালাশোকের আমলে বৈশালিতে, তৃতীয় হয় অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় পাটলিপুত্রে এবং সর্বশেষ কনিষ্কের আমলে কাশ্মিরের কুন্দনে। সেই সময়ের রাজাদের দ্বারা গ্রহন করা ধর্ম আজ গোটা বিশ্বে মানবতাবাদি মতবাদ প্রচার করেই চলেছে।
আরো পড়ুন:- ভগবান মহাবীর জয়ন্তি ও জৈন ধর্ম।
শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০
ভগবান মহাবীর জয়ন্তী ও জৈন ধর্ম || jainism and lord mahavira jayanti ||
"মহাবীর" অর্থাৎ বীরেদের মধ্যে মহান। কিন্তু কোনো এক তপস্যিকে বীরের সাথে তুলনা করা, কতটা যুক্তি যুক্ত তার বিচার না করাই ভালো। এই মহাবীরই হলেন জৈন ধর্মের প্রবর্তক। মহাবীরের জন্ম ভারতবর্ষ তথা গোটা বিশ্বের জৈন ধর্ম অবলম্বনকারিদের কাছে আনন্দ উৎসবের বাহক, যা পরিচিত "মহাবীর জয়ন্তি" বা "মহাবীর জন্ম কল্যানক" হিসাবে, তার সাথে মহাবীরের জন্ম ও আবির্ভাব বেশ রমাঞ্চকর।
মহাবীর জয়ন্তি
ভগবান মহাবীরের জন্ম সেই সময় হয়েছিল, যখন সমাজে জাত-পাতের প্রকোপ ছিল অত্যাধিক। মনে করা হয় মহাবীর ৫৪০ খ্রীষ্ট পূৰ্বাব্দে উত্তর বিহারের কুন্দপুর গ্রামের এক দলপতি সিদ্ধার্থের বাটিতে জন্ম নেন, যেটি বর্তমান বিহারের মজঃফরপুর জেলাই অবস্থিত। ভগবান মহাবীরের জন্মকে ঘিরে রয়েছে অনেক কাহিনি। কথিত আছে যে মহাবীরের আগেও তার মতাদর্শ আরো ২৩ জন মহাপুরুষ প্রচার করে গেছেন, যাদের বলা হয় "তির্থঙ্কর"। এই তির্থঙ্করের মাঝে যিনি প্রথমে এসেছিলেন তিনি হলেন ঋষভনাথ , এবং ২৩ তম ছিলেন "পার্শ্বনাথ" এবং অন্তিম ধর্মপ্রচারক মহাপুরুষ হিসাবে মহাবীরের আগমন হয়েছে।
এছাড়াও কথিত আছে যে তার জন্মের আগে মহাবীরের মা ত্রিশলা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন, যে স্বপ্নের অর্থ হিসাবে এক মহান পন্ডিত মহাবীরের জন্মের ভবিষ্যৎ বানি করেছিলেন। মহাবীরের জন্মতিথিকেই মহাবীর জয়ন্তি হিসাবে পালন করে থাকেন জৈন ধর্মের লোকেরা।
ভগবান মহাবীর |
মহাবীর হিসাবে পরিচয় লাভ
ভগবান মহাবীর নামে গোটা বিশ্বে পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে তার বাল্যনাম ছিল বর্ধমান এবং তার ভাইয়ের নাম ছিল নন্দিবর্ধন। জন্মের পর থেকেই বর্ধমানের জীবনের প্রতি একপ্রকার অনিহা লক্ষ্য করেন তার পিতা। তাই পার্থিব জীবনে বর্ধমানের মন টিকিয়ে রাখার জন্য অল্প বয়সেই তার পিতা বর্ধমানের বিয়ে দেন যশোদা নামে এক সুন্দরি কন্যার সাথে। বিয়ের পরে বর্ধমানের আনজ্জা বা প্রিয়দর্শনা নামে কন্যার পিতাও হলেন, তবুও বর্ধমানের মন সেই পার্থিব জিবনের প্রতি অনিচ্ছা রয়েই গেলো।
শেষে সংসারের প্রতি তার মায়া ত্যাগ করে জিবনের প্রকৃত সত্য জানার উদ্দেশে বেরিয়ে পরেন মাত্র ৩০ বছর বয়সে, এবং বনের মধ্যে গিয়ে শুরু করলেন কঠোর তপস্যা। যে স্থানে তিনি তপস্যাই বসেছিলেন, সেই স্থানের অনেকেই তাকে চিন্তেন এবং জানতেন, তারা প্রথমে বর্ধমানের তপস্যাই বাধ সাধলেও পরবর্তীকালে তারাই বর্ধমানের তপস্যার সাহায্যকারি হয়ে উঠেছিল। বর্ধমানের এই কঠোর তপস্যা চলেছিল একটানা ১২ বছর। এই ১২ বছরের কঠোর তপস্যাই বর্ধমান হয়ে উঠলেন প্রথমে সর্বজ্ঞ বা কৈবল্য ( যিনি সব জানেন), তারপর হয়ে উঠলেন জিতেন্দ্রিয় (যিনি ইন্দ্রিয় গুলোকে জয় করেছেন) এবং সবশেষে হয়ে উঠলেন ভগবান মহাবীর।
ধর্ম প্রচার
একটানা ১২ বছর কঠোর তপস্যার পর তার শেষ জিবনের ৩০ বছর তিনি মগধ (বর্তমানে বিহার), কোশল (উঃ প্রদেশ), চম্পা (বর্তমান বিহার), মিথিলা (বর্তমান মথুরা) ইত্যাদি স্থানগুলোতে তিনি তার ধর্মপ্রচার করেন। তিনি একজন বর্ধমান থেকে ভগবান মহাবীর হবার পরে তার প্রথম শিষ্যই হয়েছিল তার আপন জামাতা জামালি।
তৎকালিন সমাজে মহাবীরের প্রচারিত ধর্ম বিভিন্ন রাজারাও গ্রহন করেছিলেন। মহাবীর ২৩ তম তির্থঙ্কর ঋষভনাথের চারটি নিতি গ্রহন করেছিলেন, যেটি পরিচিত "চতুর্যাম" নামে। মহাবীরের ধর্ম ছিল পুনর্জন্মবাদের উপর, মহাবীরের মতে মানুষের জন্ম ও মৃত্য অবিরত চলতে থাকে যার কারন স্বরুপ মানুষের মধ্যে দুঃখের আবির্ভাব ঘটে। সুতরাং মানুষ পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি পেলেই মানুষের দুঃখের সমাপ্তি ঘটে।
ভগবান মহাবীরের মূৰ্তি |
মানুষকে এই পুনর্জন্ম থেকে রক্ষা পেতে ভগবান মহাবীর তিনটি উপায় অবলম্বনের কথা বলেন, যেটি পরিচিত "ত্রিরত্ন" নামে, আর সেগুলি হল সৎ বিশ্বাস, সৎ আচরণ, এবং সৎ জ্ঞান। এছাড়াও সৎ আচরণের নিমিত্তে তিনি পাঁচটি বিশেষ আচরণের কথাও বলেন, সেগুলি হল- হিংসা থেকে বিরত থাকা, মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়া, চুরি করা থেকে বিরত থাকা, সম্পত্তি সঞ্চয় না করা, এবং ব্রহ্মচর্য পালন করা।
মহাবীরের মৃত্য ও পরবর্তী সময়কাল
ভগবান মহাবীর নিজের ইচ্ছায় মৃত্য বরণ করে নেন। মহাবীর রাজগীরের কাছে (বর্তমান বিহার) পাবাপুরি নামের একটি স্থানে দীর্ঘকালিন অনশনের দ্বারা ৭২ বছর বয়সে ৪৬৮ খ্রীঃপূঃ মৃত্যবরণ করেন।
বাস্তবে মহাবীরের মৃত্যর পরেই মহাবীরের দ্বারা প্রচারিত ধর্ম শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। জৈন ধর্মের ধর্মগ্রন্থ মহাবীরের মৃত্যর পরেই সংকলিত হয়, যে কিতাবের নাম "দ্বাদশ অঙ্গ" বা "সিদ্ধান্ত" এছাড়াও জৈন ধর্মে একটি বিশেষ শাস্ত্রও রয়েছে যেটি পরিচিত "আগম" নামে। মহাবীরের মৃত্যর পরেই বিভিন্ন সম্মেলনের মাধ্যমেই এই ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মশাস্ত্র সংকলিত হয়। প্রযন্ত সম্মেলনের সময় বিষয়ে তেমন জানা না গেলেও এটা জানা যাই যে এটি পাটলিপুত্রে হয়েছিল স্থুলভদ্র ও সমভূতি বিজয়ের সভাপতিত্বে, যে সম্মেলনেই মহাবীরের উপদেশ গুলোকে বারোটি খন্ডে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং যা বর্তমানে জৈনদের ধর্মগ্রন্থ নামে পরিচিত। এছাড়াও এই ধর্ম সম্মেলনেই জৈনদের মাঝে দুটি সম্প্রদায় যথা- দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর হিসাবে ভাগ হয়। জৈনদের প্রথম সম্মেলনের ১০০০ বছর পর বল্লভীতে আরেকটি সম্মেলনে আয়োজন করা হয় ৫১২ খ্রীঃ, যে সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন ক্ষমাশ্রবন আর এই সম্মেলনেই জৈনদের ধর্মশাস্ত্র "আগম" লিপিবদ্ধ করা হয়।
আরো পড়ুন :- জৈন ধর্মের অন্যতম মহাপুরুষ জম্বুস্বামির কবর যেখানে ছিল।
শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০
ভারতের আবিষ্কার যেগুলোর কৃতিত্ব অন্য কেউ পেয়েছে || indian science and invention which are neglected ||
ভারতের বিজ্ঞান চর্চা বহু প্রাচীন, যার বেশীর ভাগ আজ বিদেশী আবিষ্কারকের নামে নামাঙ্কিত। সিন্ধু সভ্যতাই ধরা যাক না কেন, বর্তমান সরকার ব্যবস্থা এখনো তেমন কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি সিন্ধু সভ্যতার মতন পৌর ব্যবস্থা প্রদান করার। ভারতীয় প্রাচীন বিজ্ঞানের আভাষ পাওয়া যাই ভারতীয় প্রাচিন শিল্পকলা ও বিভিন্ন গ্রন্থে।
বস্তুত ইউরেশিয়ানদের ভারতে আগমনের পর থেকেই ভারতে অত্যাধুনিক বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়ে পরে। যার ফলস্বরুপ বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন পন্ডিতের নাম আমরা জানতে পারি, যেমন- পালযুগে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পন্ডিত চক্রপানি দত্ত, উদ্ভিদবিদ্যায় শুরপাল, শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসাই পন্ডিত বঙ্গসেন প্রমূখ। আর এই ধারাবাহিকতা একটা যুগের মধ্যেই সিমাবদ্ধ ছিল না, পরবর্তী কালে কুষাণ যুগ, গুপ্ত যুগ, প্রায় সমগ্র ভারতীয় ইতিহাসের মাঝে সিমাবদ্ধ রয়েছে, এবং যাদের আবিষ্কার বা কর্মকান্ড আজ ইতিহাসের পাতার মাঝে ছোট করে দেখা হয়।
ভারতীয় আবিষ্কার |
প্লাস্টিক সার্জারী
কুষাণ রাজত্বের সময় ভারতে শক্তিশালি রাজা হয়ে উঠে কণিষ্ক, যে সময় ভারতে স্বর্ণ-মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় ব্যাপক হারে (খ্রীঃপূঃ ১৫-২৭৫ খ্রীঃ)। এই কুষাণ আমলে জন্ম নিয়েছিল মহান দুজন চিকিৎসা বিজ্ঞানি, যাদের নাম ছিল চরক ও সুশ্রত। যার মধ্যে সুশ্রত ছিলেন বাস্তবিক ভাবে আধুনিক প্লাষ্টিক সার্জারীর জনক। সুশ্রত ছিলেন প্রথম যিনি বিশ্বে প্রথম সফলতার সাথে অস্ত্রপ্রচার,সেই সাথে প্লাস্টিক সার্জারীর দ্বারা শরিরের এক অংশের মাংস পিন্ড অন্যস্থানের ক্ষত স্থানে প্রতিস্থাপন, এছাড়া ছানির অস্ত্রোপচার করেছিলেন।
আধুনিক কালে ভারতীয় এই বিজ্ঞানিদের অবদান খুব একটা স্বীকার করা হয় না, চরক এবং সুশ্রতের চিকিৎসা পদ্ধতি তারা তাদের লেখা গ্রন্থ চরকসংহিতা এবং সুশ্রতসংহিতা তে বর্ণনা করেন। যেগুলো ৭৫০ খ্রীস্টাব্দে আরবে পৌছলে সেটি আরবে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু পরাধীন ভারতের সময় ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি ইংরাজদের হাত ধরে পশ্চিমা দেশে প্রবেশ করলে তারা সুশ্রত ও চরকের বর্ণিত চিকিৎসা পদ্ধতির আধুনিকরণ ঘটান এবং ইতিহাসের পাতা থেকে এই দুই মহান চিকিৎসা বিজ্ঞানির কার্যকলাপ একপ্রকার সরিয়ে দিয়ে নিজেদের বিজ্ঞান প্রযুক্তির জনক হিসাবে প্রচার করতে থাকে।
উড়ো জাহাজ
গোটা বিশ্ব আজ রাইট ভাইয়েদের উড়ো জাহাজ আবিষ্কারের শ্রেই দিয়ে থাকেন, কিন্তু তার ভিত্তি প্রস্তর বহু আগেই ভারতে প্রথিত করা হয়েছিল। বাস্তবিক ভাবে ভারতীয় এই আবিষ্কার চাতুরতার সাথে নিজেদের নাম জরিয়ে নেই বিদেশি এই দুই ভাই।
আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় যখন গোটা বিশ্ব উড়ো জাহাজের কল্পনাকেও অলিক কল্পনা মনে করত, তার বহু হাজার বছর আগে ভারতে তার সূচনা হয়েছিল, যার দরুন আমরা প্রাচীন গ্রন্থ গুলোতে পুষ্পক বিমান, সূৰ্য রথ ইত্যাদির বর্ণনা পেয়ে থাকি। সুতরাং ভারতীয় বিজ্ঞানে উড়ো জাহাজের ধারনা বহু প্রাচীন। ঋষি ভরদ্বাজ প্রাচীন কালেই উড়ো জাহাজ বানানোর পদ্ধতি এবং বিভিন্ন ধরনের উড়ো জাহাজের নক্সা ও কার্য প্রণালী কয়েক হাজার বছর আগেই লিপিবদ্ধ করে গেছেন তার লিক্ষিত বিমানা শাস্ত্র গ্রন্থে।
আর এই শাস্ত্রের উপরেই ভিত্তি করে রাইট ভাইদের বহু আগেই মহারাষ্ট্রের সংষ্কৃত অধ্যাপক শিবঙ্কর বাপুজি তালপাড়ে একটি উড়োজাহাজ বানিয়ে ফেলেন ১৮৫৯ সালে। তিনি জেজে স্কুল অফ আর্টের অধ্যাপক থাকা কালিন তাঁর শিক্ষক চিরঞ্জিলাল ভার্মার কাছ থেকে ঋষি ভরদ্বাজের বিমানাশাস্ত্র গ্রন্থটির বিষয়ে জানতে পারেন। যে গ্রন্থে ছিল ৩০০০ হাজারের মত শ্লোক।
রাইট ব্রাদার |
অধ্যাপক তালপাড়ে তার উড়ো জাহাজ বানানোর পর তার নাম রাখেন "মারুৎ-সখা", এবং এই উড়ো জাহাজটি সফলতার সাথে ৫০০ মিটার উপরে উড়তে সক্ষম হয়েছিল যেটি দেখতে উপস্থিত হয়েছিল বহু লোক।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হল তার এই কর্মকান্ডের কৃতিত্ব পরাধীন ভারতে থাকা ব্রিটিশদের ছল-চাতুরিতে সেই উড়োজাহাজের তথ্য বিদেশে পাড়ি দেই, আর তার সমস্ত কৃতিত্ব রাইট ভাইয়েরা নিয়ে নেই। পরবর্তি কালে তোলপাড়ের কাহিনিটি হিন্দি চলচ্চিত্র আকারে প্রকাশ পাই।
বিদ্যুৎ আবিষ্কার
আধুনিক কালে যা কিছুই অত্যাধুনিক আবিষ্কার হয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে একমাত্র বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ফলে, এক সময় এই বিদূতকে ঘিরেই টমাস আলফা এডিসন আর নিকোলা টেসলার সাথে চলেছিল স্বল্প খন্ডযুদ্ধ। যাই হোক গোটা বিশ্বে বিদ্যুৎ আবিষ্কারক হিসাবে টমাস আলফা এডিসনের কার্যকলাপকে মনে করা হয়। বস্তুতঃ টমাস আলফা এডিসন তার লেখা কিতাবে তার শ্রেয় হিসাবে মহান ঋষি অগস্ত্য কে উল্লেখ করেন। এডিসন তার কিতাবে বলেন তিনি বিদ্যুৎ তৈরির প্রারম্ভিক ধারনা মহান ঋষি অগস্ত্যুর লেখা অগস্ত্য সংহিতা থেকে পেয়েছিলেন।
মহান ঋষি অগস্ত্য হলেন ভারতীয় বৈদিক শ্রেষ্ঠ ঋষি সমূহের মধ্যে একজন, যার বিষয়ে রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য গ্রন্থ গুলোতেও পাওয়া যাই, যার নাম অনুসারে সপ্তঋষি তারকাগুলোর মধ্যে একটির নাম রাখা হয়েছে। প্রাচীন কালে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন যার মধ্যে একটি হল অগস্ত্য সংহিতা। আশ্চর্যজনক ভাবে মহান ঋষি অগস্ত্যুর এই গ্রন্থে বিদ্যুৎ তৈরির বিভিন্ন উপায় আলোচনা করা হয়েছে, এবং ব্যাটারি তৈরির বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে ব্যাটারির প্রলেপ হিসাবে জিংক,তামা, লোহা ও সোনার ব্যবহারিক পদ্ধতিও আলোচনা করা হয়েছিল। যাই হোক যদিও ব্যাটারি এডিসন আবিষ্কার করেন নি। কিন্তু ভারতীয় মহান ঋষি অগস্ত্যর উপরে নির্ভর করে এডিসন আজ বিদ্যুৎ জনক হিসাবে বিশ্ব দরবারে প্রসিদ্ধ।
রেডিও বা বেতার
ভারতে যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রেডিও আবিষ্কারের শ্রেয় আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোসকে দেওয়া হলেও, প্রায় সমগ্র বিশ্বে রেডিও আবিষ্কারের জনক হিসাবে মার্কনিকে মনে করা হয়। জগদীশ চন্দ্র বোস রেডিও আবিষ্কার করেন নি, তার সাথে গাছে প্রানের অস্তিত্ব, কেসকোগ্রাফ যন্ত্র,রেজোন্যান্ট ইত্যাদিও আবিষ্কার করেন, কিন্তু এক্ষেত্রে এর সমস্ত শ্রেয় জগদীশ চন্দ্রকেই দেওয়া হয়।
কিন্তু রেডিও আবিষ্কার বা যে আবিষ্কারের উপর নির্ভর করে অত্যাধুনিক মোবাইল, টিভি ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে তার সম্পুর্ণ শ্রেয় জগদীশ চন্দ্র বোসকে দেওয়া হয় না, বরং বেতার তরঙ্গের দ্বারা সংকেত প্রেরণের শ্রেয় দেওয়া হয়।
মূলত বেতার তরঙ্গের উপর জগদীশ চন্দ্র বোস তার যাবতীয় তথ্য ডাইরিতে লিপি বদ্ধ করে রাখতেন, পরবর্তি কালে সেই ডাইরির সংকলিত তথ্যের উপর নির্ভর করে মার্কুনি রেডিও বা বেতার যন্ত্র আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন।
ফাইবার অপটিকাল
বিশ্ব খুব শিঘ্রই মহান আবিষ্কারের সম্মুখিন হতে পারে, যার কল্পনা করা বাস্তবেও খুবি অবাস্তব বলে মনে হয়, কিন্তু আশার আলো দেখা গিয়েছে তাও এক ভারতীয় বিজ্ঞানির প্রচেষ্টাই, কিন্তু ইতিহাসের পাতাই তার নাম হয়তো বা নাও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে,যিনি হলেন ডঃ নারেন্দ্র সিং কাপানি। বিজ্ঞানের বিচারে কোন বস্তু যদি আলোর বেগের থেকেও বেশি বেগে ভ্রমন করতে পারে তবে সেক্ষেত্রে "টাইম মেসিন" বা সময় যন্ত্র তৈরি করা যেতে পারে। বিজ্ঞান স্বিকার করে নিয়েছে সময় সব ক্ষেত্রেই সমান হয় না এছাড়াও আলোকে বাঁকানো যাই না, কিন্ত ফাইবার অপটিকালে তা সহজ হয়েছে। কিন্তু গোটা বিশ্বে সেই আবিষ্কারের শ্রেই চার্লস কুয়েন কাউ কে দেওয়া হয়েছে এবং তাকেই এর জনক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও বা এই প্রযুক্তির প্রথম সুত্রধার ডঃ নরেন্দ্র সিং কাপানি। বর্তমানে এই প্রযুক্তি ঘর সাজানোর উপকরন, আলোকসজ্জা এবং দ্রত তথ্য সরবরাহের জন্য করা হচ্ছে।
ফাইবার অপটিকাল |
ভারত শুধু এই কয়েকটি আবিষ্কারের মধ্যে সিমাবদ্ধ তেমনটিও নই, বিজ্ঞানের প্রত্যেক ক্ষেত্রে ভারতীয়দের অবদান অপরিসীম যুগ যুগ ধরে, কিন্তু শুধুমাত্র ভারতীয় হবার সুবাদে তার কৃতিত্ব হাতছাড়া হয়েছে। অনু পরমানুর বিষয়ে প্রথম ধারনা একজন ভারতীয় দিয়েছিলেন যিনি হলেন ঋষি কণাদ। ভারতের প্রাচীন মহাকাশবীদরাই বলেছিলেন পৃথিবী স্থিরতা এবং গণিতশাস্ত্রে '০' (শূন্য) এর মাহাত্ম্য। আরো প্রচুর আবিষ্কার রয়েছে যেগুলো প্রচীন গ্রন্থ গুলিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে, এখন সময়ের অপেক্ষা যাতে সেই সমস্ত বিষয়বস্তু সকল, পাশ্চাত্য দেশগুলো না করায়ত্ত্ব করে ফেলে। প্রয়োজন ভারতীয় গবেষনার, সেই গ্রন্থগুলোর সত্যতা যাচাই করার। "মোহিনী-বিদ্যা" ভারতীয় মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি,যেটি পাশ্চাত্যে প্রবেশের সাথে সাথে বিজ্ঞানের রুপ নিয়েছে। তেমনি রয়েছে মন্ত্র বিদ্যা, যদিও এটার সত্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিন্তু তার মধ্যে যদি কিঞ্চিত পরিমান সত্যতার ভিত্তি থাকে তবে তা যেন পাশ্চাত্য কলার অংশিদারী না হয়।
আরো পড়ুন - এই রোগগুলো আপনাকে সুপার হিরো বানাতে পারে।
বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২০
ভারতিয় সিনেমার ইতিহাস ও বাংলা || HISTORY OF INDIAN CINEMA AND BENGAL ||
ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস। INDIAN CINEMA
সিনেমার জন্ম নিকোলাস লুমিয়ার ও জিন লুমিয়ার নামে ফরাসি দুই ভাই দিয়েছিলেন ১৮৯৫ সালে। সেই সময় সিনেমায় শব্দের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তাই তাদের তৈরি প্রথম বিশ্বের চলচ্চিত্র THE ARRAIVAL OF A TRAIN AT THE STATION টি ছিল নির্বাক। ফরাসি এই দুই ভাইকেই চলচ্চিত্রের জনক মনে করা হয়। এই দুই ভাই নিজেরাও তাদের এই আবিষ্কার যে খুব দ্রুত বিশ্বের ধনি ও অভিজাতদের কাছে আকর্ষনের বিষয় হয়ে দ্বাড়াবে তার কল্পনা হয়তো তারা করেন নি। দেখতে দেখতে সারা বিশ্বে সিনেমাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের মুনাফা অর্জনে লেগে পড়ে এবং স্থানের নাম অনুসারে বিভিন্ন ইন্ডস্ট্রি গড়ে উঠে ~ যেমন হেমিল্টন শহর থেকে হলিয়ুড, বোম্বে থেকে বলিয়ুড, লাহোর থেকে লালিয়ুড, টালিগঞ্জ থেকে টলিয়ুড ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভারতিয় সিনেমা |
ভারতে সিনেমার আগমন। INDIAN CINEMA
ফ্রান্সে তৈরি চলচ্চিত্রের ভারতে আসতে দেরী করেনি, ফ্রান্সে তৈরি হওয়া লুমিয়ার ব্রাদারের বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র THE ARRAIVAL OF A TRAIN AT THE STATION ভারতে তার তৈরি হবার পরের বছরি বোম্বাই (বর্তমান নাম মুম্বাই) এর তৎকালিন বিলাসবহুল হোটেল ওয়েষ্টনে প্রদর্শিত হয়। ১৮৯৯ সালে প্রথম ভারতীয় হিসাবে সখারাম ভাতওয়াদেকর দুটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের সিনেমা তৈরি করেন যার নাম ছিল দ্যা রেষ্টলার এবং মেন এন্ড মাংকি কিন্তু সেটিও সম্পূৰ্ণরুপে ভারতীয় ছিল না, যার মধ্যে কিছুটা অংশ ব্রিটিশদের যোগদান ছিল। ভারতের সম্পূৰ্ণ নিজের ঘরানায় সিনেমা তৈরি করেন ধুন্দিরাম গোবিন্দ ফালকে , যিনি ইতিহাসে দাদাসাহেব ফালকে নামে পরিচীত। যদিও সেই চলচ্চিত্রটি ছিল নির্বাক,কিন্তু সেই ছবিটিকেই ইংরাজি ও হিন্দি সাব টাইটেল রাজা হরিশচন্দ্র দিয়ে মুক্তি দেওয়া হয় ১৯১৩ সালে।
বাংলাই চলচ্চিত্র বা সিনেমা
প্রথমে চলচ্চিত্রের উপর ব্রিটিশ কোম্পানির নজর থাকলেও তা অভিজাতদের বিনোদনের অংশ হওয়াই কোম্পানি এর উপর তার লাগাম সম্পূৰ্ন রুপে ছেড়ে দেন, সেই সময় ব্রিটিশের একজন জে.জে.স্টিভেনশন নেতৃত্বে কলকাতার স্টার থিয়েটারে ১৮৯৬ সালের ২১ শে ডিসেম্বরে লুমিয়ার ব্রাদারের চলচ্চিত্র প্রথম দেখানো হয়, এরপর থেকেই বাঙ্গালীদের চলচ্চিত্রের উপর তাদের ছাপ ছাড়তে শুরু করে।
সেই সময় সিনেমায় অভিনয় করা নিম্নমানের কাজ মনে করা হত, বিশেষ করে নারিদের ক্ষেত্রে, তাই বাঙ্গালী দুই ভাই হিরালাল সেন ও মতিলাল সেন রয়াল বাইস্কোপ কোম্পানি প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের উৎসাহ দিতে থাকেন, এবং তাদের এই কোম্পানি থিয়েটারে প্রদর্শিত নাটকের দৃশ্যেগুলিকে রেকর্ড করে এবং কিছু ডকুমেন্টারি ভিডিও মিলিয়ে ২১ টি ছবি তৈরি করেন। তাদের পরিচালনায় মুক্তি পাই আলিবাবা এন্ড থার্টি থিবস এবং তাদেরি চেষ্টাই ভ্রমর নামে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস কৃষ্মকান্তের উইল কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে চলচ্চিত্র আকারে প্রদর্শিত হয়। তাদের সিনেমা জগতে অশেষ যোগদানের জন্য তাদের ভারতীয় লুমিয়ার ব্রাদার বলা হয়।
১৯১৭ সালে জে.এম.মেডান তার এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানির আওতাই বাংলাই প্রথম কাহিনিচিত্র সত্যবাদি রাজা হরিশ্চন্দ্র নির্মান করেন, কিন্তু এতদিন পর্যন্ত কোনো প্রকার চলচ্চিত্রে শব্দের অস্তিত্ব ছিল না, সিনেমাতে প্রথম শব্দের অস্তিত্ব আসে ১৯৩১ সালে, এবং সেই বছরি বিদেশি মেডানের জামাইষষ্টি নামের সবাক বাংলা চলচ্চিত্র মুক্তিলাভ করে। না বললে নই ভারতে প্রথম অস্কার পুরষ্কারটি এসেছিল একজন বাঙ্গালির হাত ধরেই , তিনি হলেন সত্যজিৎ রায়, তার ১৯৫৫ সালে তৈরি সিনেমা পথের পাঁচালি একমাত্র ফিল্ম যেটি অষ্কারে ভূষিত হয়েছে।
"পথের পাঁচালি" সিনেমার একটি দৃশ্য |
ভারতীয় সিনেমার উদয়। INDIAN CINEMA
ভারতে সিনেমা আসার পরেই তার যাত্রা শুরু করে, সেই যাত্রাই নতুন পালক জুড়ে দেই ইম্পেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানির তৈরি আলম আরা সিনেমা। এই সিনেমাটিকেই ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মনে করা হয়, মজার বিষয় হল সবাক চলচ্চিত্র হিসাবে এই সিনেমাতেই প্রথম গান চিত্রনাট্য করা হয় দে দে ক্ষুদাকে নাম পে প্যার।
এর পর একে একে এই বছরেই তেলুগু ভাষাই "ভক্ত প্রহ্লাদ" এবং তামিল ভাষাই "কালিদাস" মুক্তি পাই। বিভিন্ন ভাষাই তৈরি সিনেমা গুলো দ্রত জনপ্রিয় হতে শুরু করে এবং ১৯৩৭ সালে আর্দেশ ইরানি নামের একজন কিষন কন্যা নামের প্রথম রঙ্গিন সিনেমা তৈরি করেন।
ভারতের বলিউড এখন বিশ্বের দরবারে তার প্রসার ঘটিয়েছে, যার ফলে ইংলেন্ডের লেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয় বলিউডকে তাদের বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। খুব দ্রত ভারতীয় সিনেমা জগৎ বিশ্বের দরবারে তার নাম নথিভুক্ত করলে ১৯৫২ সালে ভারতে প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হয়। ভারতীয় সিনেমার (INDIAN CINEMA)এই অবদানের পিছনে দাদা সাহেব ফালকে অন্যতম ,যিনি তার একক প্রচেষ্টাই সেই সময় মোট ৯১ টি সিনেমা তৈরি করেছিলেন, এবং নার্গিস দত্ত তার মাদার ইন্ডিয়া সিনেমার জন্য বিশ্বে সুনাম কুরিয়েছেন আর এই সিনেমাই ছিল প্রমথ অস্কারের জন্য প্রেরিত সিনেমা।
"আলম আরা" চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য |
এর পর এক এক করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইতিহাস তৈরি করে আসছে ভারতিও সিনেমা জগৎ। ভারতিয় সমাজে সিনেমার প্রভাব বাড়তে থাকলে এই জগতে রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পুরষ্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা হয় যার শুরুতে প্রথম পেয়েছিল শ্যামবাঈ আলি এবং প্রথম ফিল্মফেয়ারে ভূষিত হয় বিমল রায়ের "দো বিঘা জমিন"। ভারতীয় ধারায় প্রথম ত্রিমাত্রিক 3D চলচ্চিত্র তৈরি হয় "ছোটা চেতন" এবং সব থেকে বেশি গান রয়েছে ইন্দ্রসভা সিনেমাই। কিন্তু তার মাঝে ভারতীয় সিনেমাকে ঘিরে বিতর্ক হয়েছেও প্রচুর, যার মধ্যে একটি ভারতীয় সিনেমাই প্রথম মুখ-চুম্বন,যেটি রয়েছে কার্মা নামের সিনেমাই (১৯৩৯)।
আরো পড়ুন = নকল ইলিশ মাছ থেকে সাবধান।
সোমবার, ৬ জুলাই, ২০২০
ভাষা, সংষ্কৃতি, ও ধর্ম হারানোর শঙ্কায় মাহালী উপজাতি , ও মাহালি জাতির উপর আগ্রাসন নিতি (১ম পর্ব)|| ORIGIN OF MAHALI TRIBE (1st PART) ||
মাহালী শব্দটা আজ প্রায় শুধু খাতা কলমে নিমজ্জীত , মাহালীরা ক্রমশঃ তার ভাষা ও সংষ্কৃতি ক্রমশঃ হারানোর পথে, তাই মাহালী আদিবাসীদের একাংশের মনে নিজের ঐতিহ্য ,ভাষা ও সংষ্কৃতি হারানোর আশঙ্কার ভয় দেখা দিয়েছে।
চা পাতা তুলতে ব্যাস্ত মাহালী নারি |
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য উত্তরবঙ্গের দার্জিলীং জেলা , জলপাইগুড়ি জেলার চা বাগানগুলিতে মুন্ডা, ওড়াঁও, লেপচা , ভূটিয়া, মাহালি জনজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, এমন কি উত্তরবঙ্গ লাগোয়া আসামের বঙ্গাইগাঁও জেলার চা বাগানগুলিতেও মাহালী ,সাঁওতাল , মুন্ডা, ওড়াঁও ইত্যাদির সংখ্যা লক্ষ্য করা যাই। এমনাবস্থাই অল্পসংখ্যক মাহালীদের উপর আগ্রাসনের প্রভাব ফেলাটাই স্বাভাবিক।
বাঁশের কাজের ব্যাস্ততাই মাহালী |
তথাপি একপ্রকার মাহালীদের মধ্যে আগ্রাসন বিভিন্ন পদে বিভিন্ন ভাবে হয়েছে , উপরক্ত ঐতিহাসিক তথ্য প্রমানাদির অভাব ও বিশেষ লিখিত কোনো দস্তাভেজ না থাকার দরুন মাহালি জাতীর অবক্ষয় , প্রসারণ , ও পরিবর্তিত ভাষাতাত্ত্বিক দিকটি বিভিন্ন সূত্ৰ তথা ঐতিহাসিক ঘটনাবলির প্রবাহমানকে প্রমান হিসাবে ধরে নিয়ে চলতে হয়।
ভারতে গোঁদ উপজাতীর সংখ্যা সর্বাধিক কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখা গেলেও উত্তরবঙ্গের প্রশস্ত চা বাগানগুলোতে ওড়াঁও ,মুন্ডা ,কোড়া ,লোধা ,ভূমিজ ,ভূটিয়া , লেপচা, মাহালীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখা যায়। মাহালীদের আদি বাসভূমি হিসাবে বর্তমান ঝাড়খন্ডের দুমকা জেলাকে (মারে দিশম) মনে করা হয়। কালক্রমে সেই স্থান হতে মাহালীরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, বিশেষত তাদের ছড়িয়ে পরার মূল কারনটি কায়িক শ্রম ও পর্যাপ্ত পরিমানে বিভিন্ন স্থানে ঘড়োয়া বাঁশের ব্যবহারিক সামগ্রির চাহিদাপূরন। দার্জিলিং তথা জলপাইগুড়ি , এছাড়া আসামের বঙ্গাঁইগাঁও এলাকার চা বাগান গুলোতে মাহালিদের ছড়িয়ে পরার কারন হিসাবে অভিঙ্গ কায়িক শ্রমিকের চাহিদা পূরন বলা যেতে পারে।
বিষয়টি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই বিচার করা যাক - ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবসায়িক ছাড়পত্র পেয়ে ব্যবসা শুরু করে, এবং কালক্রমে এসে চীনের সহিতে সংঘাতও বেধেছিল কোম্পানির। সেই থেকেই শুরু হলো চায়ের বিশ্বায়ন।
যাই হোক, দেখতে দেখতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে চিনের উৎপাদিত চা ব্রিটেনে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো।
মনে করা হয় স্কটিশ বটানিস্ট রবার্ট ফরচুন ১৮৪২ সালে তিনি চীনে পারি দেন এবং ১৮৪৮ সালে চীন থেকে চায়ের বীজ ও চারা সংগ্রহ করে নিয়ে এসে কলকাতায় গভর্নর জেনারেলকে দেন চা চাষের উদ্দেশে, দার্জিলিং তার মধ্যে একটি জায়গা। সৌভাগ্যক্রমে দার্জিলিং-এর মাটি, আবহাওয়া ঐ চায়ের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছিলো। দার্জিলিং ও কার্সিয়াং অঞ্চলের মাকাইবাড়ি এলাকায় প্রথম চা ফ্যাক্টরি তৈরী হ'ল ১৮৫৯ সালে। শুরু হল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন কর্মকান্ড , পর্যাপ্ত পরিমানে শ্রমিকের চাহিদা পূরনের উদ্দৈশে তরাই, ডুয়ার্স, ছোটনাগপুর ইত্যাদি অঞ্চল থেকে ওড়াঁও ,মুন্ডা ,কোড়া ,লোধা ,ভূমিজ , মাহালী ইত্যাদি উপজাতীদের আনা হল।
দার্জিলিং জেলাই অবস্থানরত মাহালী পরিবার |
ব্রিটিশ কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার থাকাই এই চা বাগানের সহজ সরল আদিবাসীদের মধ্যে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচার করা হয়ে পরে খুবই সহজপন্থা ।
মাহালী উপজাতীরা অতিত কাল থেকেই জাতীগত , ভাষাগত, ধর্মগত আগ্রাসণের শিকার হয়ে আসছে অনবরত।
কথিত আছে যে, সেইন্ট টমাস ছিলেন প্রথম খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক যিনি ৫০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন , এবং রাজা হেলিওডোরাসকে খ্রীষ্ট ধর্মে দিক্ষীত করেন। কোম্পানি বাহাদুর খ্রীষ্ট ধর্মকেও বহন করে আনেন ভারতে, যদিও খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারে ওলন্দাজরা প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহন করে, তথাপি কোম্পানির খ্রীষ্ট ধর্ম পৃষ্ঠপোষকতায় ১৬৩৩ সালে শাহজাহানের এক ফরমান এর মাধ্যমে গির্জার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু বিশেষ সুবিধাসহ ৭৭৭ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন। আঠারো শতকের শেষ দশকে ব্রিটিশ প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মপ্রচারকদের আগমনের সাথে সাথে বাংলায় খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার কাজ একটি সংগঠিত আন্দোলনের রূপ নেই। সমসাময়িক ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের পুনরুজ্জীবনের ফলে সকল দেশে খ্রিস্টের বাণী প্রচারের জন্য বেশ কয়েকটি ধর্মপ্রচারক সমিতি গঠিত হয়। এগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো ১৭৯২, ১৭৯৫ ও ১৭৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত যথাক্রমে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি, লন্ডন মিশনারি সোসাইটি ও চার্চ মিশনারি সোসাইটি যারা তৎকালিন বিহার প্রদেশের আদিবাসী এলাকা গুলোকে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারে আদর্শ স্থান হিসাবে বেছে নেন , ক্রমে এখানকার প্রাকৃতি পুজারী রুপি মাহালীদের মাঝে খ্রীষ্ট ধর্ম জায়গা করতে থাকে , মূলত এই আদিবাসী সমূহের মাঝে মাহালীরাও এই খ্রীষ্ট ধর্মাবেগের প্রতি আকৃষ্ট হন। মাহালী উপজাতীর উপর খ্রীষ্ট ধর্মের এই আগ্রাসন এই প্রযন্তই থেমে থাকেনি , তার শুরু বহুকাল আগে থেকেই।
মাহালীদের উপর খ্রীষ্ট ধর্মের আগ্রাসন |
বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসাবে বলা যেতে পারে সাঁওতাল ও মাহালী উপজাতির মধ্যে ভাষাগত মিলের আধিক্য রয়েছে , খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ধর্মপ্রচারকদের পূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ উপজাতিদের ওপর তাঁদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে , এই স্থানে সাঁওতাল উপজাতিদের পাশাপাশি মাহালী উপজাতিদেরো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। দূর্বোধ আদিবাসীদের মাঝে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারে মূল বাধা হয়ে দ্বারাই ভাষাগত বৈষম্য , সুতরাং সাঁওতাল তথা মাহালী ও অন্যান্য আদিবাসীদের মাঝে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারের কাজ সহজ করার প্রচেষ্টাই উপজাতিদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা মূলক গবেষনা চালানো শুরু হয় , এই বিষয়ে P.O BOURDING গবেষণাকর্ম সানতাল ডিক্সনারী (৫ খন্ডে, ১৯৩২-১৯৩৬ সালে প্রকাশিত) এবং L.O সানতাল গবেষনাই এই তথ্য পাওয়া যাই। (গবেষনা কালিন তারা মাহালি ও সাঁওতাল দের মধ্যে কতটা পার্থক্য করতে পেরেছিল তা নিয়ে আমার ব্যাক্তিগত সন্দেহ রয়েছে)
প্রতিবেদনটি পড়তে চেপে ধরুন |
(চলবে)