"মহাবীর" অর্থাৎ বীরেদের মধ্যে মহান। কিন্তু কোনো এক তপস্যিকে বীরের সাথে তুলনা করা, কতটা যুক্তি যুক্ত তার বিচার না করাই ভালো। এই মহাবীরই হলেন জৈন ধর্মের প্রবর্তক। মহাবীরের জন্ম ভারতবর্ষ তথা গোটা বিশ্বের জৈন ধর্ম অবলম্বনকারিদের কাছে আনন্দ উৎসবের বাহক, যা পরিচিত "মহাবীর জয়ন্তি" বা "মহাবীর জন্ম কল্যানক" হিসাবে, তার সাথে মহাবীরের জন্ম ও আবির্ভাব বেশ রমাঞ্চকর।
মহাবীর জয়ন্তি
ভগবান মহাবীরের জন্ম সেই সময় হয়েছিল, যখন সমাজে জাত-পাতের প্রকোপ ছিল অত্যাধিক। মনে করা হয় মহাবীর ৫৪০ খ্রীষ্ট পূৰ্বাব্দে উত্তর বিহারের কুন্দপুর গ্রামের এক দলপতি সিদ্ধার্থের বাটিতে জন্ম নেন, যেটি বর্তমান বিহারের মজঃফরপুর জেলাই অবস্থিত। ভগবান মহাবীরের জন্মকে ঘিরে রয়েছে অনেক কাহিনি। কথিত আছে যে মহাবীরের আগেও তার মতাদর্শ আরো ২৩ জন মহাপুরুষ প্রচার করে গেছেন, যাদের বলা হয় "তির্থঙ্কর"। এই তির্থঙ্করের মাঝে যিনি প্রথমে এসেছিলেন তিনি হলেন ঋষভনাথ , এবং ২৩ তম ছিলেন "পার্শ্বনাথ" এবং অন্তিম ধর্মপ্রচারক মহাপুরুষ হিসাবে মহাবীরের আগমন হয়েছে।
এছাড়াও কথিত আছে যে তার জন্মের আগে মহাবীরের মা ত্রিশলা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন, যে স্বপ্নের অর্থ হিসাবে এক মহান পন্ডিত মহাবীরের জন্মের ভবিষ্যৎ বানি করেছিলেন। মহাবীরের জন্মতিথিকেই মহাবীর জয়ন্তি হিসাবে পালন করে থাকেন জৈন ধর্মের লোকেরা।
ভগবান মহাবীর |
মহাবীর হিসাবে পরিচয় লাভ
ভগবান মহাবীর নামে গোটা বিশ্বে পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে তার বাল্যনাম ছিল বর্ধমান এবং তার ভাইয়ের নাম ছিল নন্দিবর্ধন। জন্মের পর থেকেই বর্ধমানের জীবনের প্রতি একপ্রকার অনিহা লক্ষ্য করেন তার পিতা। তাই পার্থিব জীবনে বর্ধমানের মন টিকিয়ে রাখার জন্য অল্প বয়সেই তার পিতা বর্ধমানের বিয়ে দেন যশোদা নামে এক সুন্দরি কন্যার সাথে। বিয়ের পরে বর্ধমানের আনজ্জা বা প্রিয়দর্শনা নামে কন্যার পিতাও হলেন, তবুও বর্ধমানের মন সেই পার্থিব জিবনের প্রতি অনিচ্ছা রয়েই গেলো।
শেষে সংসারের প্রতি তার মায়া ত্যাগ করে জিবনের প্রকৃত সত্য জানার উদ্দেশে বেরিয়ে পরেন মাত্র ৩০ বছর বয়সে, এবং বনের মধ্যে গিয়ে শুরু করলেন কঠোর তপস্যা। যে স্থানে তিনি তপস্যাই বসেছিলেন, সেই স্থানের অনেকেই তাকে চিন্তেন এবং জানতেন, তারা প্রথমে বর্ধমানের তপস্যাই বাধ সাধলেও পরবর্তীকালে তারাই বর্ধমানের তপস্যার সাহায্যকারি হয়ে উঠেছিল। বর্ধমানের এই কঠোর তপস্যা চলেছিল একটানা ১২ বছর। এই ১২ বছরের কঠোর তপস্যাই বর্ধমান হয়ে উঠলেন প্রথমে সর্বজ্ঞ বা কৈবল্য ( যিনি সব জানেন), তারপর হয়ে উঠলেন জিতেন্দ্রিয় (যিনি ইন্দ্রিয় গুলোকে জয় করেছেন) এবং সবশেষে হয়ে উঠলেন ভগবান মহাবীর।
ধর্ম প্রচার
একটানা ১২ বছর কঠোর তপস্যার পর তার শেষ জিবনের ৩০ বছর তিনি মগধ (বর্তমানে বিহার), কোশল (উঃ প্রদেশ), চম্পা (বর্তমান বিহার), মিথিলা (বর্তমান মথুরা) ইত্যাদি স্থানগুলোতে তিনি তার ধর্মপ্রচার করেন। তিনি একজন বর্ধমান থেকে ভগবান মহাবীর হবার পরে তার প্রথম শিষ্যই হয়েছিল তার আপন জামাতা জামালি।
তৎকালিন সমাজে মহাবীরের প্রচারিত ধর্ম বিভিন্ন রাজারাও গ্রহন করেছিলেন। মহাবীর ২৩ তম তির্থঙ্কর ঋষভনাথের চারটি নিতি গ্রহন করেছিলেন, যেটি পরিচিত "চতুর্যাম" নামে। মহাবীরের ধর্ম ছিল পুনর্জন্মবাদের উপর, মহাবীরের মতে মানুষের জন্ম ও মৃত্য অবিরত চলতে থাকে যার কারন স্বরুপ মানুষের মধ্যে দুঃখের আবির্ভাব ঘটে। সুতরাং মানুষ পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি পেলেই মানুষের দুঃখের সমাপ্তি ঘটে।
ভগবান মহাবীরের মূৰ্তি |
মানুষকে এই পুনর্জন্ম থেকে রক্ষা পেতে ভগবান মহাবীর তিনটি উপায় অবলম্বনের কথা বলেন, যেটি পরিচিত "ত্রিরত্ন" নামে, আর সেগুলি হল সৎ বিশ্বাস, সৎ আচরণ, এবং সৎ জ্ঞান। এছাড়াও সৎ আচরণের নিমিত্তে তিনি পাঁচটি বিশেষ আচরণের কথাও বলেন, সেগুলি হল- হিংসা থেকে বিরত থাকা, মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়া, চুরি করা থেকে বিরত থাকা, সম্পত্তি সঞ্চয় না করা, এবং ব্রহ্মচর্য পালন করা।
মহাবীরের মৃত্য ও পরবর্তী সময়কাল
ভগবান মহাবীর নিজের ইচ্ছায় মৃত্য বরণ করে নেন। মহাবীর রাজগীরের কাছে (বর্তমান বিহার) পাবাপুরি নামের একটি স্থানে দীর্ঘকালিন অনশনের দ্বারা ৭২ বছর বয়সে ৪৬৮ খ্রীঃপূঃ মৃত্যবরণ করেন।
বাস্তবে মহাবীরের মৃত্যর পরেই মহাবীরের দ্বারা প্রচারিত ধর্ম শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। জৈন ধর্মের ধর্মগ্রন্থ মহাবীরের মৃত্যর পরেই সংকলিত হয়, যে কিতাবের নাম "দ্বাদশ অঙ্গ" বা "সিদ্ধান্ত" এছাড়াও জৈন ধর্মে একটি বিশেষ শাস্ত্রও রয়েছে যেটি পরিচিত "আগম" নামে। মহাবীরের মৃত্যর পরেই বিভিন্ন সম্মেলনের মাধ্যমেই এই ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মশাস্ত্র সংকলিত হয়। প্রযন্ত সম্মেলনের সময় বিষয়ে তেমন জানা না গেলেও এটা জানা যাই যে এটি পাটলিপুত্রে হয়েছিল স্থুলভদ্র ও সমভূতি বিজয়ের সভাপতিত্বে, যে সম্মেলনেই মহাবীরের উপদেশ গুলোকে বারোটি খন্ডে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং যা বর্তমানে জৈনদের ধর্মগ্রন্থ নামে পরিচিত। এছাড়াও এই ধর্ম সম্মেলনেই জৈনদের মাঝে দুটি সম্প্রদায় যথা- দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর হিসাবে ভাগ হয়। জৈনদের প্রথম সম্মেলনের ১০০০ বছর পর বল্লভীতে আরেকটি সম্মেলনে আয়োজন করা হয় ৫১২ খ্রীঃ, যে সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন ক্ষমাশ্রবন আর এই সম্মেলনেই জৈনদের ধর্মশাস্ত্র "আগম" লিপিবদ্ধ করা হয়।
আরো পড়ুন :- জৈন ধর্মের অন্যতম মহাপুরুষ জম্বুস্বামির কবর যেখানে ছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন