প্রাথমিক পরিচিতি
দক্ষিন দিনাজপুর আমাদের প্রীয় জেলা। আর এই জেলার বিভিন্ন এলাকাই ছরিয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন কালের বিভিন্ন ঐতিহাসিক সাক্ষি বহনকারী বিভিন্ন ধংসাবশেষ। কিন্তু দুংখের বিষয় হল যদিও প্রশাসন এগুলি রক্ষার্তে এগিয়ে এসেছে, তবুও তা যথেষ্ট না। আর পাশাপাশি এটাও বলতে চাই, দক্ষিন দিনাজপুরের ইতিহাস জেলাবাসির কাছে খুব একটা পরিচিত না, আর যার ফলে দক্ষিণ দিনাজপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। আর এটা আমার ছোট একটি প্রচেষ্টা যাতে দক্ষিণ দিনাজপুরের মানুষ এই জেলার প্রকৃত ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানতে পারে।
গঙ্গারামপুর শহর আমার বাড়ির শহর, সেইজন্য আমি দক্ষিণ দিনাজপুরে অবস্থিত আমার শহরকে হৃদয় থেকে ভালোবাসি।দক্ষিণ দিনাজপুরে জেলা তার সমৃদ্ধশালী ঐতিহাসিক স্থানসমূহ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর পৌরাণিক সংযোগের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত, আর যে বিষয় সমূহ গুলো বিভিন্ন গ্রন্থে রয়েছে এছাড়াও অনেক পাণ্ডুলিপিতে বর্ণনা করা হয়েছে। পূর্বে পশ্চিমবাংলার অবিভাজিত দিনাজপুর জেলা সমূহ একটি অংশ হিসাবে পরিচিত ছিল যা প্রাচীনকালে পুন্ড্র বর্ধন নামে পরিচিত ছিল।
বৃহৎ কথাকোষ অনুসারে চন্দ্রগুপ্ত পুন্ড্র বর্ধনের দেবকোটের একজন ব্রাহ্মণের পুত্র ছিলেন, যিনি ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রাচীনকালে গঙ্গারামপুর দেবিকোট নামে পরিচিত ছিল এবং এটি সেই সময়ের রাজধানী ছিল, আর এই নাগরিক ধ্বংসাবশেষগুলো এখনও পাওয়া যায় এবং গঙ্গারামপুরের বানগড়ের চারপাশে এটির প্রমাণ পাওয়া যায় ।
যাই হোক আমাদের দক্ষিণ দিনাজপুরের ইতিহাস সত্যিই খুব প্রাচীন, সার যোগসূত্র বিভিন্ন মহাকাব্য আর পৌরাণিক কাহিনীতে পাওয়া যায়, যার মধ্যে প্রধান হল মহাভারত, শীবপুরান, বিষ্ণুপুরাণ আর না জানি কত গ্রন্থে বলা হয়েছে।
BIRUPAKSYA TEMPLE GANGARAMPUR |
সত্যেই মন্দিরময় আমাদের এই দক্ষিণ দিনাজপুর। আমাদের জেলার সেই সমস্ত ক্ষমতা রয়েছে যে গোটা ভারতের আমাদের জেলাকে ধর্মীয়পিঠস্হানে পরিণত করতে পারে, কিন্তু প্রশাসনের সতইচ্ছা আর কিছুটা জনগনের কাছে সঠিক ইতিহাস ও তথ্য না থাকার ফলে আমাদের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা আজ ধর্মীয় পিঠস্হান বা ধামে পরিণত হতে পারে নি।
বিরূপাক্ষ শিব মন্দির।
তবে আজকে আপনাদের যে মন্দিরের বিষয়ে জানাবো, সেটি পৌরাণিক কাহিনীর সাথে যুক্ত, আর যে মন্দিরের বিষয়ে শিব পুরানের রুদ্রসংহিতায় সম্পুর্নরুপে বলা হয়েছে। এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি এই মন্দিরটির সঠিক প্রচার পাই তবে এই মন্দিরটি খুব সহজেই ভারতের বুকে একটি ধর্মিয় স্থান বা ভারত প্রসিদ্ধ ধামে পরিণত হতে পারত। আর সেই মন্দিরটি গঙ্গারামপুর শহরের শিববাড়িতে অবস্থিত, আর এই মন্দিরের নাম হল " বিরূপাক্ষ মন্দির" ।তবে বিরূপাক্ষ মন্দিরের বিষয়ে আলোচনা করার আগে আপনাদের কয়েকটি বিষয়ে অবগত হওয়া প্রয়োজন। যা আমি প্রথমেই তুলে ধরছি।বিরূপাক্ষ শব্দের অর্থ
গঙ্গারামপুর শিববাড়িতে অবস্থিত বিরূপাক্ষ মন্দিরটিতে অবস্থিত শিবলিঙ্গটিকে "বাণেশ্বর " হিসাবেও ডাকা হয়েছে, আর এই " বাণেশ্বর " শব্দের অর্থ হল বানরাজার ঈশ্বর বা ভগবান। আর "বিরূপাক্ষ" শব্দের অর্থ হল, ভক্তের প্রতি শিবের কৃপাদৃষ্টি আর একিসাথে দুষ্ট বা শয়তানের ধংস্বকারি।বানাসুর বা বানরাজা কে
বানাসুর বা বানরাজা এই বিরূপাক্ষ মন্দিরের নির্মাণ করেন। হিন্দুধর্ম গ্রন্থ শীবপুরান আর বিষ্ণু পুরাণ অনুসার ,অসুররাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণু ভক্ত, অসুররাজ হিরণ্যকশিপু ,বিষ্ণুর শিংহাবতার নরশিংহের দ্বারা নিহত হলে তার পুত্র প্রহ্লাদ রাজা হন, আর এই রাজা প্রহ্লাদের সন্তান ছিলেন বিরোচন , আর এই বিরোচনের পুত্র ছিলেন অসুররাজ দানবীর বলি আর এই বলির পুত্র ছিলেন বিখ্যাত বানাসুর বা বানরাজ। আর এই বানরাজার নাম অনুসারে গঙ্গারামপুর তথা দক্ষিণ দিনাজপুরের বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থানটির নাম রাখা হয়েছে বানগড়।বিরূপাক্ষ মন্দিরটির নির্মাণ
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ শীবপুরানের মতে অসুররাজ বান বা বানরাজা ছিলেন একজন শৈব বা শিব ঠাকুরের উপাসক। আজ বর্তমানে যেখানে বিরূপাক্ষ মন্দিরটি রয়েছে সেই স্থানেই বানরাজা শিবের উপাসনায় তপস্যাই বসেন। তপস্যারত বানরাজার তপস্যাই ভগবান শিব মুগ্ধ হলে তিনি বানরাজকে স্বয়ং দর্শন দেন, এবং বানরাজকে শহস্রবাহুর বরদান করেন। সুতরাং পুরান অনুযায়ী বানরাজার একশোটির মত হাত ছিল।যাইহোক, পরম শিবভক্ত বানরাজের প্রকৃত ইচ্ছা ছিল তার শিবশংকর ভগবান যেন তার সাথেই থাকেন। ভক্তের এই কাতর প্রার্থনাই ভগবান শিব নিজেকে স্বয়ং লিঙ্গ রুপে বিয়োজিত করেন, আর এই শিবলিঙ্গটি এই বিরূপাক্ষ মন্দিরে এখনো রয়েছে ।
অনান্য ঐতিহাসিক তথ্য
এই বার আসি এই বিরূপাক্ষ মন্দিরের অন্যান্য ঐতিহাসিক প্রেখাপট নিয়ে, স্বাধীনতার পুর্বে অবিভক্ত ভারতের তথা বর্তমান বাংলাদেশের নাটোরের রানি ভবানির জমিদারি এলাকার মধ্যে এই মন্দিরটি অবস্থিত ছিল, এমনকি রানি ভবানীও এই মন্দিরটিতে পুজো দিতে আসতেন।রানি ভবানির জমিদারি আমলে এই মন্দিরটির মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল 100 একরের মত কিন্তুু দখলদারিদের বেলাগাম জবরদখলের ফলে সেই জমির পরিমাণ এখন মাত্র 4 একর 70 শতকে গিয়ে দারিয়েছে।
বর্তমানে সেখানে বিরূপাক্ষ মন্দিরটি রয়েছে ঠিক তার পাশেই ছিল একটি দুর্গা আর আরেকটি কালিঠাকুরের মন্দির, এছাড়াও এখানে একটি হনুমান ঠাকুরের ও মন্দির রয়েছে যেটি কালের নিয়মে মাটির নিচে চাপা পরে গেছে, শুধুমাত্র এখন সেই হনুমান মন্দিরের চুড়াটাই মাটির উপরে দেখতে পাওয়া যায়।
হনুমান মন্দিরের চুড়া |
যাইহোক, এই বিরূপাক্ষ মন্দিরের পাশে আরো দুটি কালি ঠাকুরের আর দুর্গা ঠাকুরের মন্দির ছিল, কিন্তুু 1206 খ্রীঃ বিখ্যাত তুর্কিবীর বখতিয়ার খিলজি বাংলা দখল করার সাথে সাথে বাংলাই মুসলিম শাষনের শুরু হয়, আর বাংলাই মুসলিম শাষনের শুরু হলে বখতিয়ার খিলজি বাংলার বুকে থাকা বিভিন্ন বৌদ্ধ মঠ আর বিভিন্ন হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে ফেলতে শুরু করেন। আর ঠিক সেই সময়েই বখতিয়ার খিলজি এখানে অবস্থিত সেই দুর্গা মন্দির আর কালি মন্দিরটি ধংস্ব করে দেন, কিন্তুু এখানে অবস্থিত বিরূপাক্ষ মন্দিরটির তেমন কোন ক্ষতি করতে পারেন নি, শুধুমাত্র এই বিরূপাক্ষ মন্দিরের চুড়াটি ভাঙ্গতে সক্ষম হয়েছিলেন মাত্র, অন্যদিকে তিনি এখানে অবস্থিত বিরূপাক্ষ শিবলিঙ্গটির কোন প্রকার ক্ষতি করতে পারেন নি।
অন্যান্য বিষয়
বর্তমানে এখানকার অধিবাসীদের প্রচেষ্টাই আর বংশপরম্পরাই চলে আসা সেবায়েতগনের সহযোগিতায় এই মন্দিরটির উন্নতিসাধনের চেষ্টা চলছে আর তাদের একান্ত প্রচেষ্টাই শিবরাত্রির পবিত্র পক্ষে এই মন্দিরে বিশেষ অনুষ্ঠান পালিত হয়, যার ফলে এই বিরূপাক্ষ মন্দিরে এই তিথিতে প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে। এছাড়া এই মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে এখানে বারুনি মেলা আর শ্রাবণ মাসে একমাস ধরে শ্রাবনি মেলার আয়োজন করা হয়।পুর্বে নাটোরের রানি ভবানী এই বিরূপাক্ষ মন্দিরের সেবা করার উদ্দেশ্যে সেবায়েত নিযুক্ত করেন ,যেটি বংশপরম্পরাই আজো চলে আসছে যা নিম্নরুপ।
সেবায়েতগনের তালিকা
লাখেরাজ ব্রহ্মচারী মহারাজ* শিবনাথ চক্রবর্তী।
* উমানাথ চক্রবর্তী
* কেদার নাথ চক্রবর্তী
চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী।
সােমনাথ চক্রবর্তী।
বদ্রিনাথ চক্রবর্তী।
‘রামরতন চক্রবর্তী।
রজনীনাথ চক্রবর্তী।
বেলাকেশ্বর চক্রবর্তী
নিখিলেশ্বর চক্রবর্তী
নকুলেশ্বর চক্রবর্তী।
* লক্ষীনাথ চক্রবর্তী।
চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
শশীশেখর চক্রবর্তী
* বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী
* সুরেশ্বর চক্রবর্তী
শৈলেশ্বর চক্রবর্তী
° সীতানাথ চক্রবর্তী
* শিবশঙ্কর চক্রবর্তী
* অনিল কুমার চক্রবর্তী
ভজন কুমার চক্রবর্তী।
শ্ৰীযুক্ত অহিভূষণ চক্রবর্তী
শ্রীযুক্ত পঞ্চানন চক্রবর্তী
শ্ৰীযুক্ত গৌতমকুমার চক্রবর্তী
শ্ৰীযুক্ত প্রলয় চক্রবর্তী
শ্ৰীযুক্ত গােপাল গােস্বামী
শ্রীযুক্ত গৌর গােস্বামী
শ্ৰীযুক্ত তন্ময় চক্রবর্তী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন