আমাদের দক্ষিণ দিনাজপুরের ইতিহাস জানার পিছনে যে সমস্ত প্রত্নতান্ত্রিক নিদর্শন বেশি সাহায্য করেছে সেগুলো হলো বিভিন্ন লিখিত উপাদান বা বিভিন্ন শিলালেখ বা তামার পাতের উপর লিখিত আকারে খোদাই করা বেশ কিছু নিদর্শন (তাম্রপট্ট)। ইতিমধ্যে ঐতিহাসিকদের কাছে দক্ষিণ দিনাজপুরের ইতিহাস বিষয়ে যে সমস্ত লিখিত উপাদান রয়েছে তা সে কোন শিলালিপি হোক বা তাম্রপট্ট, তার বেশির ভাগই পাওয়া গিয়েছে
গঙ্গারামপুরের বানগড় ও গঙ্গারামপুরের বিভিন্ন পার্শ্ববতী এলাকাই এছাড়া ও বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় বিভিন্ন স্থানে আরো কিছু লিখিত উপাদান পাওয়া গেছে সেগুলো দক্ষিণ দিনাজপুর সহ বাংলার বিভিন্ন কালের ইতিহাস বর্ননা করে। আমাদের প্রীয় জেলা দক্ষিণ দিনাজপুর বাস্তবেই ইতিহাসের দিক দিয়ে একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে, আর এই ইতিহাসের বিচারে গঙ্গারামপুর ছিল এই সমস্ত ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কেন্দ্র বিন্দু । বিভিন্ন শিলালিপি, স্তম্ভলিপি ও বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত তাম্রপট্টের পাশাপাশি কিছু গ্রন্থ থেকে এই জেলার গঙ্গারামপুরের বিশেষ উৎকৃষ্ঠতার কথা জানতে পারা যায়।
|
গঙ্গারামপুর বানগড় |
যার মধ্যে প্রধান হল কবি সন্ধ্যাকর নন্দির রামচরিত, এছারাও বায়ুপুরান ও বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে ও এই স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা থেকে এই সময়ে গঙ্গারামপুর তথা দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রাচুর্যের কথা জানতে পাওয়া যায়। তবে এই সমস্ত গ্রন্থের পাশাপাশি যে সমস্ত শিলালেখা আমাদের জেলার ইতিহাস জানার বিষয়ে অগ্রগন্য সেগুলোর বেশ বড় অংশ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর তথা তার পার্শ্ববর্তী এলাকাই বিশেষ করে বানগর এলাকাই পাওয়া গেছে। যেমন- পালযুগের কিছু শিলালিপি ও তাম্রপট্ট, উদাহারনসরুপ পালরাজ মহিপালের তাম্রপট্ট ও পালরাজ নয়পালের শিলালিপি যেগুলো
গঙ্গারামপুরের বানগড় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এছারা গৌরের কুঞ্জরাঘবনের শিলালিপি এই বানগর থেকে উদ্ধার করা হয়। এছারাও বানগর থেকে আবিষ্কৃত পালযুগের যে সকল শিলালিপি বা তাম্রপট্ট উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে মহিপালের তাম্রলিপি প্রধান ।
। মহিপাল তাম্রপট্ট ।
মহিপালের এই তাম্রপট্ট থেকে দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের পূর্বনাম জানতে পারা যায়, আর সেই নাম হল কোটিবর্ষ। এই তাম্রপট্টতে উল্লেখ আছে বানগর রাজ দেবিকোট নগরটি এক ব্রাম্ভনকে দান হিসাবে দিয়েছিলেন, আর এই তথ্যটি সমর্থিত করে সন্ধ্যাকর মন্দির লিখিত গ্রন্থ রামচরিত কেও।কারণ এই গ্রন্থে সন্ধ্যাকর নন্দি কোটিবর্ষ কে সম্পুর্ন ভাবে ব্রাম্ভ্রনদের আশ্রিত নগর বলেছেন।
। নয়পালের শিলালেখ।
পালরাজ নয়পালের বানগড় শিলালেখ বানগড় গঙ্গারামপুর থেকে উৎখনিত হয় , এই শিলালেখাতে কিছু উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ মঠ ও কিছু মন্দিরের উল্লেখ্য পাওয়া যায়।
। কুঞ্জরাঘবনের শিলালিপি ।
বানগড়ে আবিষ্কৃত এই শিলালিপিটি বানগড়ে উদ্ধার হওয়া কোন এক ধ্বংসপ্রাপ্ত শিব মন্দিরের স্তম্ভে ক্ষদিত ছিল, যেটি বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছে। যার পাঠদ্ধারের পর দক্ষিণ দিনাজপুরের একটি জটিল দিক উন্মোচিত হয়েছে। কারণ, এই শিলালিপিটি ছিল দশম শতকের এবং ঠিক রাজা মহীপাল ও রাজা নয়পালের মধ্যবর্তী সময়ের। এইখানে এই জিনিসটি মনে রাখতে হবে যে কুঞ্জরাঘবন ছিলেন গৌড়ের শাসক ও তার পাশাপাশি তিনি ছিলেন কোম্বজ বংশীয়, সুতরাং যেহেতু এই শিলালিপিটি বানগড় থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল সেহেতু অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে দক্ষিণ দিনাজপুর সহ বেশ কিছু এলাকা মহীপাল ও নয়পালের রাজত্বের মধ্যবর্তী সময়ে কোম্বজ বংশীয় রাজাদের হাতে চলে গিয়েছিল ।
এছাড়াও তপন এলাকার কয়েকটি জায়গা থেকে কিছু শিলালিপি ও তাম্রপট্ট পাওয়া গেছে সেগুলো সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় যে সেই সময় কোটিবর্ষ ছিল বাংলার অন্যতম প্রসিদ্ধ নগরী।
। মৌলানা আতাউদ্দিন শাহের শিলালিপি।
বর্তমানে এই শিলালিপিটি দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাই অবস্থিত গঙ্গারামপুরের ধলদিঘীর উত্তরপারে
আতা শাহের দরগার গাত্রে মোট চারটি শিলালিপি এখনো রয়েছে। যেহেতু আতা শাহ একজন সুফিসন্ত ছিলেন, তাই সহজেই বলা যায় যে, সুলতানী আনলে দেবিকোট সুফিবাদের আতুরঘরে পরিণত হয়েছিল।
|
আতা শাহের শিলালিপি গঙ্গারামপুর |
এই শিলালিপি থেকে জানা যায় সুলতান রুকনুউদ্দিন একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে এই শিলালিপিটিকে মৌলানা আতাউদ্দিন কবরগাত্রে স্থাপন করা হয়।
। বৈগ্রাম তাম্রপট্ট ।
অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর জেলার হিলির বৈগ্রামে (বর্তমান হিলি দঃ দিনাজপুর) 1930 খ্রীঃ তৎকালিন নায়েব কৃষ্ণচন্দ্র সাহা একটি পুকুর খনন করার সময় অর্ধপ্রাকৃত ভাষায় লেখা 9" * 5" বিশিষ্ট কয়েকটি গুপ্তযুগের তামার পাত বা তাম্রপট্ট খুজে পান। এই তাম্রপট্ট থেকে জানা যায় গুপ্ত যুগে আমাদের জেলা পুন্ড্রবর্ধন নামে পরিচিত ছিল। মুলত এই তাম্রপট্টটি ছিল গুপ্ত যুগের কোন এক জমির দলিল, যেটি বর্তমানে বৈগ্রাম তাম্রপট্ট নামে পরিচিত। যেহেতু এটি ছিল একটি জমির দলিল সেহেতু এই তাম্রপট্ট থেকে সেই সময়ের জমি পদ্ধতির বিষয়ে অনেক কিছুই জানা যায়।
। আমার কিছু কথা।
এই সমস্ত প্রামাণ্য থেকে এতটুকু তো পরিষ্কার যে, বাংলার ইতিহাসে আমাদের জেলার গুরুত্ব কতটা ছিল, আবার এটাও পরিষ্কার যে এখন আরো অনেক শিলালিপি ও তাম্রপট্ট রয়েছে যেগুলো আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারবে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা যে সমস্ত শিলালিপি এখনো উদ্ধার হয় নি। এছাড়া এমন অনেক গ্রন্থ রয়েছে যেগুলো আমাদের জেলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব উজাগার করেছে। আমি চেষ্টা করব খুব শিঘ্রই সেই সমস্ত গ্রন্থ ও গ্রন্থে উল্লেখিত সেই সমস্ত বিষয় সমূহ আপনাদের জানানোর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন