History of dakshin dinajpur, bangla bible, DAKSHIN DINAJPUR, Uttar DINAJPUR, Malda, chiristanity, santhal,indian tribe,mahli tribe, unknown facts, tourist place of Malda, tourist place of Dakshin DINAJPUR ,bible, bible story, bible story in bangla,dakshin dinajpur news,adibashi,sautal,indian tribe culture,

TRANSLATE ARTICLE TO YOUR LANGUEGE

শুক্রবার, ১০ জুলাই, ২০২০

মাহালি বা মালহে উপজাতির বিশেষ উৎসব জিতীয়া || JITIYA FESTIVAL OF MAHALI TRIBE ||


 জিতিয়া উৎসব

স্বর্গীয় যাকারিয়াস ডুমরী (বাংলাদেশ)


প্রত্যেক জাতির আত্ম পরিচয়ের প্রথম বাহন হচ্ছে তার আবহমান কাল ধরে প্রচলিত কৃষ্টি বা সংস্কৃত।  এই সংসস্কৃতি যুগযুগ ধিরে অন্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে এলে পুনরায় তা গতিশীল ও সমৃদ্ধশালী হয় এবং পূর্ণ বিকাশ ঘটে থাকে। এছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব রীতি নীতি আচার-অনুষ্ঠান বা উৎসব রয়েছে এবং এই উৎসব বা পার্বণ ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্ব বোধ সৃষ্টির মহান উৎসব হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর প্রতিটি জাতিরই বৈচিত্র পূর্ণ উৎসব রয়েছে বা সেই জাতির কোন মহান মনীষী প্রচলন করেছেন অথবা সেই জাতি তার নিজস্ব প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছে। তেমনি মাহলে বা মাহালী জাতির  এই ধরনের এক মহান উৎসব বা পার্বণ হচ্ছে জিতিয়া। জিতিয়া আভিধানিক অর্থ বিজয়।
পৃথিবীতে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি আছে। তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র এবং অজানা এক জাতি হল মাহলে বা মাহালী। এদের বসবাস বাংলাদেশ (প্রায় ত্রিশ হাজার), ভারত (প্রায় পাঁচ লক্ষ) এবং নেপালে (প্রায় এক হাজার)। তাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। আরও রয়েছে নিজস্ব ঝুমের নাচ, গান, ঐতিহ্য রীতিনীতি ও উৎস।  মাহলে জাতির যে সমস্ত  উৎসব রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান উৎসব হচ্ছে " জিতিয়া"।
জিতীয়া উৎসব কালীন নৃত্য
এই উৎসব একটি সামাজিক উৎস।  এই উৎসব আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে একটি লোক কাহিনী রয়েছে৷ এই লোক কাহিনী হল,
কোন এক সময়ে মাহলে জাতিতে জন্ম গ্রহন করেছিলেন একটি কন্যা শিশু। জন্মের পর থেকেই সেই কন্য শিশুটি দেখতে যেমন ছিলেন রূপবতী তেমন তার কথা বার্তা চাল চলন। দিন দিন তার বুদ্ধি মত্তার প্রখরতা দেখা দিতে লাগল। কন্যা শিশুটি যখন বেড়ে উঠতে লাগলো তখন থেকেই ছড়িয়ে পড়তে লাগলো তার জ্ঞান গরিমার কথা। দলে দলে লোক আসত তার দর্শনের জন্য ও জ্ঞানের কথা শোনার জন্য। এভাবে কাল ক্রমে তার রুপ এবং জ্ঞানের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। এক সময়ে সে পূর্ণ যুবতী হলো।
সেই মহীয়সী নারীটি পূর্ণ যুবতী হলেও মাহলে সমাজে তার যোগ্য পাত্র না পাওয়া যাওয়াই তার বিয়ে হল না। কিন্তু তার পান্ডিত্য, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় বিভিন্ন দেশ থেকে পন্ডিত ব্যক্তি বর্গ তাকে দেখতে এবং তার কথা শুনতে আসতো। এইভাবে এক সময় মাহলে জাতির সেই মহীয়সী নারীর কথা স্বয়ং ঈশ্বর শুনতে পেলেন এবং তার কথা শোনার পর তিনি স্থির করলেন তাকে পরীক্ষা করবেন। স্বয়ং ঈশ্বর সেই যুবতী নারীকে পরীক্ষা করার জন্য স্বয়ং নিজেই পৃথিবীতে ভিক্ষুক বেশে আবির্ভূত হকেন। ভিক্ষুক বেশ ধারণ করার কারন ছিল যে, সেই মহীয়সী নারী কতটুকু অহংকারী এবং সাধারণ মানুষকে কতটুকু শ্রদ্ধা করেন এবং ভালবাসেন তা পরীক্ষা করেন ৷ ঈশ্বর ভিক্ষুক বেশে বাড়িতে এলেন এবং ভিক্ষা চাইলেন। তখন যুবতী নারী ভিক্ষুককে সামনে মাহলে পোষাকে শালীন ভাবে এলেন এবং ভক্তি ভরে প্রণাম করে তার আবেদন মনোযোগ সহকারে শুনলেন। অতঃপর যুবতী নারী ভিক্ষুককে ভিক্ষা প্রদান করলেন।
যুবতীর নারীর আচরণ ও সম্মান বোধ দেখে ঈশ্বর তার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট হলেন এবং চলে যেতে যেতে আশীর্বাদ করলেন ও বললেন যে, "তোমার গর্ভে হতে একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিবে"। এই কথা শুনে সেই মহীয়সী যুবতী নারী  বিচলিত হলেন এবং বললেন,  " আমি তো অবিবাহিতা কেমন করে আমার পুত্র সন্তান হবে?" তাছাড়া তিনি সংকল্প করেছিলেন যে তিনি কোন দিনই বিয়ে করবেন না।
মাহালী সমাজ
ঈশ্বর অন্তর্যামী তাই তিনি সেই নারীর মনের ইচ্ছার কথা জানতে পারলেন। ঈশ্বর চিন্তা করলেন কিভাবে সেই আশীর্বাদ পূর্ণ করবেন। সেই সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে  এসেছে৷ তখন ঈশ্বর সেই বাড়ির জানালার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন৷ এবার তিনি সেই জানালার পাশে কিছু গান্ধারী ( মাহলে ভাষায়) শাকের বীজ ছড়িয়ে দিলেন এবং বললেন, "আগামী কাল সকাল বেলা সেই গান্ধারী শাক গজিয়ে উঠবে এবং এই শাক খেলে কুমারীর গর্ভে পুত্র সন্তান আসবে" অতঃপর ঈশ্বর অদৃশ্য হলেন।
প্রতিদিনের মত সেই যুবতী নারী সকালে জানালার ধারে এসে পূর্বের উপাসনার হিন্য দাঁড়িয়েছে। আর ঠিক তখনই দেখতে পেলেন লক লক করে বেড়ে উঠা সেই সুন্দর গান্ধারী শাকের গাছ। আর তার মনের মধ্যে তখন খাবার সাধ জেগে উঠলো। সূর্য উপাসনা শেষ করার পর দ্রুত বাড়ীর বাহিরে এসে আচলে শাক তুলে যত্ন করে বাড়ী নিয়ে এলো। অতঃপর সেই গান্ধারী শাক সুন্দর ভাবে রান্না করে তৃপ্তি সহকারে খেল এবং সুন্দর শাকের জন্য সূর্য দেবতাকে ধন্যবাদ জানাল।
মাহলে এই লোক কাহিনীর মতে সেই দিন থেকে গান্ধারী শাকের জন্ম হয়েছে এবং এই শাক আশীর্বাদ যুক্ত।
এই গান্ধারী শাক খাওয়ার পর সেই মহীয়সী নার‍ি গর্ভবতী হয়ে পড়ে এবং এই গর্ভধারনের সংবাদ বিদ্যুৎ  গতিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।  চারিদিক থেকে শোনা যায় নিন্দা আর ধিক্কারের ঝড়। কিন্তু সেই মহীয়সী নারী বুঝতে পারে না কিভাবে সে গর্ভবতী হলো। অবশেষে নির্দিষ্ট সময়ে জন্ম নিল সেই মহান শিশু। যার নাম যুগ যুগ ধরে মাহলে জাতি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে থাকেন। তিনি হলেন জিৎ বাহান ঠাকুর।
যখন জিৎ বাহান বেড়ে উঠতে লাগলেন তখন থেকেই তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। কিন্তু তার জন্ম এবং তার পিতা কে? এই সম্পর্কে মানুষ বিভিন্ন কথা বলায় সে অতীষ্ট হয়ে উঠলো। তাই তার মাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করে তুললো। এমন পরিস্থিতিতে  জিৎ বাহানের মা একদিন প্রত্যুষে জানালার পার্শ্বে জিৎ বাহান'কে নিয়ে গেল এবং সূর্য দেখিয়ে বললো, "তোমার পিতা কে তা ঐ সূর্য বলে দিতে পারবে এবং সূর্য উদিত হবার আগেই তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।" জিৎ বাহান এই কথা শোনার পর পরই রওনা হলেন সূর্যকে জিজ্ঞাসা করার জন্য। সূর্য উঠার আগেই তিনি সূর্যের নিকট এসে তার সামনে দাড়িয়ে বললেন, "তুমি যদি সত্য কথা বল তবে তোমাকে যথা সময়ে পূর্ব আকাশে উদিত হতে হবে নচেৎ আমি তোমার পথ আগলে রাখবো" এই কথা শোনার পর সূর্য তাকে বললেন, "তোমার কি সেই প্রশ্ন যার জন্য এতদূর এসেছ" জিৎ বাহান বলেন, " তোমাকে বলতে হবে আমার পিতা কে?"  এই কথা শোনার পর সূর্য্য কোন উত্তর না দিয়ে পূব আকাশে উদিত হতে চাইলেন। কিন্তু জিৎ বাহান তাকে পূব আকাশে উদয় হতে সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দিলেন। উভয়ের মধ্যে শুরু হল প্রতিদ্বন্দ্বিতা তথা লড়াই। শেষ পর্যন্ত জিৎ বাহানের কাছে সূর্যের হার হল। সূর্য্য বলেন, "আমিই তোমার পিতা, আজই প্রথম আমি তোমর কাছে হেরে গেলাম।তোমার জিত হলো।" সূর্য্য আবার বললেন, "আজ থেকে এই বিজয় স্মরণীয় করে রাখার জন্য তোমার নাম হবে জিৎ বাহান ঠাকুর। এই স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তোমার পরবর্তী বংশের জন্য প্রচলন হোক জিতিয়া উৎসব।  প্রতি বছর তারা মাসের ৮ম দিবাগত রাত্র থেকে এই উৎসব পালন করবে"। জিৎ বাহান ঠাকুর বিজয় লাভ করার পর তার গ্রামে মার কাছে  ফিরে এলেন। তিনি প্রচলন করলেন জিতিয়া উৎসব। জিৎ বাহান ঠাকুর শুধু জিতিয়া উৎসবই প্রচলন করেন নাই, তিনি বহু সমাজ কল্যাণ মূলক কাজ করেন। পাশাপাশি সমাজ সংস্কারও করেন।
পড়ার জন্য চেপে ধরুন
এই লোক কাহিনীকে কেন্দ্র করে জিতিয়া উৎসবের প্রচলন হয়। আজও মাহলে জাতির সেই মহা সাধক পুরুষকে স্মরণ করে থাকেন।
মূল অনুষ্ঠানঃ
  জিতিয়া উৎসব মূলত সামাজিক উৎস।  এই উৎসবে বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় তিন দিন আগে থেকে সেই বাড়ির লোক তিন দিন ব্যাপী উপবাস করে থাকেন। জিতিয়ার দিন তারা গান্ধারী শাক দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি বা সুড়ে দাকা খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করে থাকেন। বাড়ির স্ত্রী লোকেরা জিতিয়ার পূর্ব রাতে সকলে যখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়ে তখন তেল পিঠা সহ বিভিন্ন পিঠা রান্না করা হয়।
জিতিয়ার দিক সকালে স্নান করেন এবং ছোট শিশু থেকে শুরু করে সকলে নতুন নতুন পোষাক পরিধান করে৷ স্ত্রী লোকেরা নতুন বাড়িতে বিভিন্ন ধরণের পিঠা, বিভিন্ন রকমের সবজি ও ফল নিয়ে গ্রাম প্রধান মন্ডলের বাড়িতে নিয়ে আসেন। অতঃপর গ্রামের জগ-মন্ডল বা সহকারী মন্ডল এই খাদ্য দ্রব্য ও সবজি ফল আশির্বাদ করেন তার পর সকলের নিকট খাবার গুলো বিতরণ করা হয়। ঐ দিকে বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। পিঠার স্বাদ পেয়ে ছোট শিশুরা আত্মহারা হয়ে বাড়ীতে ঘুরে বেড়াই মনের আনন্দে। যুবক যুবতী ও প্রাপ্ত বয়স্ক গণ বিভিন্ন বাড়ীতে যায় সঙ্গে মাদল ও হারমোনিয়াম থাকে, চলে ঝুমের নাচ ও গান। প্রায় প্রতি বাড়ীতে অতিথি নিমন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। এই সময়ে মেয়ে-জামাই কে নিমন্ত্রণ করে আনা হয়। প্রায় বাড়ীতে হান্ডি (মাহলে দের তৈরী ভাতের মদ) খাওয়া হয় এবং মনের আনন্দে ঝুমের নাচ গান চলে অনের রাত পর্যন্ত।
মাহালীদের হান্ডী বা মদ
মাহলে সংস্কৃতিতে জিতিয়া উৎসব এক অনন্য স্থান করে আছে। এই জিতিয়া উৎসব মাহলেদের সামাজিক উৎস।  এই উৎসব মাহলেদের মধ্যে গড়ে তোলে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব। এই উৎসব ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি মাহলেদের অন্তরে সৃষ্টি হোক মাহলে জাতীয় ঐক্যের। 
WhatsApp

1 টি মন্তব্য: