History of dakshin dinajpur, bangla bible, DAKSHIN DINAJPUR, Uttar DINAJPUR, Malda, chiristanity, santhal,indian tribe,mahli tribe, unknown facts, tourist place of Malda, tourist place of Dakshin DINAJPUR ,bible, bible story, bible story in bangla,dakshin dinajpur news,adibashi,sautal,indian tribe culture,

TRANSLATE ARTICLE TO YOUR LANGUEGE

রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বালুরঘাটের ইতিহাস: প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগের এক শহর।। History of Balurghat: A City from Ancient to Modern Age।।

 বালুরঘাট দক্ষিণ দিনাজপুরের সদর, সময়ের উত্থান পতনের ইতিহাস বয়ে নিয়ে আজ একুশ শতকের আঙ্গিনায় পৌঁছে গেছে। বর্তমানে একুশটি ওয়ার্ড নিয়ে তৈরি বালুরঘাট পৌরসভা। এক সময়‌ পশ্চিম দিনাজপুরের অংশ হিসেবে বালুরঘাট শহর প্রতিষ্ঠিত থাকলেও পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে দক্ষিণ দিনাজপুর এবং উত্তর দিনাজপুর পৃথক ভাবে অস্তিত্বে এলে বালুরঘাট দক্ষিণ দিনাজপুরের সদর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

আত্রেয়ী নদীর তীরে গড়ে উঠা এই ছোট শহরে, আত্রেয়ী নদীর জলপ্রবাহের ধারার মতো বয়ে গেছে যুগের পর যুগ। প্রাচীন থেকে বর্তমান সবকিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে এই শহরে।

 প্রাচীন যুগ

বালুরঘাটের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে ইতিহাসের ধারা, প্রাচীন যুগে মৌর্য, গুপ্ত, কুষাণ, শুঙ্গ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বালুরঘাট ছিল অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীন যুগে বালুরঘাট পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের অংশ ছিল। বেদে উল্লেখ একটি বিশেষ জাতির লোকেরা পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল। পুন্ড্রবর্ধনের অস্তিত্বে বালুরঘাটের ইতিহাস সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষন না বালুরঘাটের পার্শ্ববর্তী এলাকা বা দক্ষিণ দিনাজপুরের ইতিহাস যুক্ত‌ না করা হয়। হরষেন রচিত প্রাচীন গ্রন্থ বৃহৎ কথা কোষ‌ অনুযায়ী মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থাপক চন্দ্রগুপ্ত পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের দেবীকোট শহরের এক ব্রাহ্মণের সন্তান ছিলেন। বর্তমানে এই দেবীকোট হিসেবে গঙ্গারামপুরকে চিহ্নিত করা হয়। এই সময় দেবীকোট ছিল ব্রাহ্মণদের আশ্রিত মন্দিরে পরিপূর্ণ শহর। আবার আরেক তথ্য অনুযায়ী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জৈন গুরু ভদ্রবাহু দেবীকোটে জন্মগ্রহণ করেছিল।

গুপ্ত যুগে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাষন কাল থেকেই বালুরঘাট তথা তার পার্শ্ববর্তী এলাকা উন্নতি লাভ করতে থাকে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উত্তর পুরুষ হিসেবে দ্বিতীয় কুমার গুপ্ত তার এই কার্যকলাপকে অনবরত রাখেন , এবং কয়েকটি বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করেন। দ্বিতীয় কুমার গুপ্তের নাম অনুসারে বালুরঘাটের পার্শ্ববর্তী একটি এলাকার নাম হয়েছে কুমারগঞ্জ। হিলির বৈগ্রাম নামের একটি গ্রামে একটি তাম্রপট্ট ( তামার পাতলা পাতের উপর লিখিত আকারে দস্তাবেজ) পাওয়া গেছিল, যেটি থেকে প্রথম কুমার গুপ্ত এর জমি ব্যবস্থা জানা যায়। যেখান থেকে বোঝা যায় যে এই এলাকায় গুপ্ত শাষকের রাজ ছিল। এখনো দক্ষিণ দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে উঠে আসা প্রাচীন কালের মূর্তিগুলো সেই সময়ের শিল্পকলার উৎকর্ষতা প্রমাণ করে আসছে প্রতিনিয়ত।

মধ্যযুগ

প্রাচীন যুগের বিষয়ে তেমন কিছু তথ্য না পাওয়া গেলেও মধ্য যুগে বালুরঘাট এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহের উন্নতি সাধন হয়েছিল তা নিঃ সন্দেহে বলা যায়। বিশেষ করে পাল সাম্রাজ্যের সময়ে, পাল যুগের কয়েকটি রাজার নাম অনুসারে বালুরঘাটের পার্শ্ববর্তী কয়েকটি এলাকার নাম রয়েছে, যেমন - মহিপাল, রামপুর, গোপালপুর, এছাড়াও আরো কয়েকটি স্থান রয়েছে।

প্রথম মহিপাল প্রজাহৈতষী রাজা হিসেবে পরিচয় লাভ করেন। তিনি উত্তরবঙ্গ সহ পূর্ব বঙ্গের বেশ কিছু রাজ্যে জয়লাভ করেন, যার ফলে বালুরঘাট তার রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। কৃষক তথা জনগণের জন্য কয়েকটি দিঘী খনন করেন, যার একটি রয়েছে মহিপাল এলাকায়, যেটি বর্তমানেও মহিপাল দিঘী নামেই পরিচিত। 

তবে এখানেই শেষ নয়, পাল সাম্রাজ্যের অন্যতম রাজা ধর্মপাল যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেন, তার একটি বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণ দিনাজপুরের কোন এক স্থানে করেছিলেন, অনেক ঐতিহাসিকদের মতে সেটি বর্তমানে হরিরামপুর অথবা বালুরঘাটের কোনো পাশ্ববর্তী এলাকাতে অবস্থিত ছিল।

পাল বংশের অবনতি ঘটতে থাকে দ্বিতীয় মহিপালের‌ সময়ে, তার দ্বারা শাসিত ১০৭০-১০৭৫ সাল পর্যন্ত রাজত্ব কালে তার অপশাসন কৈবর্ত জনগনকে বিদ্রোহ করে তুলেছিল। কৈবর্তরা দিব্যক নামের এক নেতার নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। বালুরঘাট থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত মুরারীবাদ নামের স্থানে কৈবর্তরা একত্রিত হয়ে দিব্যক, ভিম নামক নেতাদের নেতৃত্বে যুদ্ধের ঘোষণা করেছিল।


আরো পড়ুন - মালদার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।।


মধ্যযুগের ইতিহাস এখানেই থেমে থেকেছিল এমনটি না। দ্বাদশ শতকে দিকে বালুরঘাটের উপরে হিন্দু সেন বংশের রাজত্ব ছিল। এরপর ১২০৬ সালে বখতিয়ার খিলজীর দ্বারা হঠাৎ আক্রমনের মাধ্যমে লক্ষন সেন পালিয়ে গেলে, বালুরঘাট সহ দক্ষিণ দিনাজপুরে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হিন্দু ধর্মে পরিচালিত দক্ষিণ দিনাজপুরের মাটিতে মুসলিম শাসন লাভ করলে , হিন্দুদের মাঝে মুসলিম ধর্মের দর্শন তুলে ধরার প্রয়োজন পরে, যেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল মৌলানা আতা উদ্দিন শাহ, যার সমাধি এখনো গঙ্গারামপুরের ধলদিঘীতে রয়েছে। এমনকি বখতিয়ার খিলজীর সমাধি এখনো গঙ্গারামপুরে রয়েছে।

বালুরঘাটের ইতিহাস: প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগের এক শহর।। History of Balurghat: A City from Ancient to Modern Age।।
বালুরঘাট স্বাধীনতা সংগ্রাম

এরপর ১৪৯৯-১৫৩৩ পর্যন্ত যে যে সুলতানরা শাসন করেছিলেন, তারা সকলেই বালুরঘাট এলাকায় বিশেষ নজরদারি রেখেছিলেন, যারা হলেন সামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ, নাসিরুদ্দিন নাসরত শাহ প্রমূখ। যাদের মধ্যে হুসেন শাহের নাম আজও সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয় বালুরঘাট লাগোয়া হোসেনপুর গ্রামে।

মুঘল আমলে বালুরঘাট মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে, কিন্তু এতবড় সাম্রাজ্যে মুঘল শাষকের একার দ্বারা পরিচালনা করা সহজ ছিল না। সুতরাং মুঘল শাষকের সহযোগী হিসেবে হিন্দু রাজা কাশীনাথ রায় বালুরঘাটের কাছেই আত্রেয়ী নদীর তীরে দূর্গ নির্মাণ করেন।

আধুনিক যুগ

সময়ের ব্যবধানে বালুরঘাট সহ সমগ্র বাংলাই ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে আসে , সেই সময় বাংলার এই অংশ শাসন করতেন রাজা রাধানাথ রাই। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বাংলার ফকির আর সন্ন্যাসীরা গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, যেখানে ফকিরদের নেতৃত্ব দিয়েছেন মজনু শাহ এবং সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দেন ভবানী পাঠক। মূলতঃ এরা রংপুর, কুড়িগ্রাম থেকে গেরিলা যুদ্ধের পরিচালনা হলেও, প্রয়োজনে বালুরঘাট কেও তারা গেরিলা যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করতেন। 

স্বাধীনতা প্রেমী বালুরঘাট বাসিন্দাদের মধ্যে দেশভক্তি তুলে ধরতে একে একে কাজী নজরুল ইসলাম, মুকুন্দ দাস, এমনকি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বালুরঘাট পরিদর্শনে আসেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বালুরঘাটের আত্রেয়ী নদীর তীরে কংগ্রেসের কার্যালয় স্থাপন করেন।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বালুরঘাটের বাসিন্দারা একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৪২ সালের ভারতছাড়ো আন্দোলনে বালুরঘাটে নেতৃত্ব দেন সরোজরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, কানু সেন, শুটকা বাগচী প্রমূখ। আত্রেয়ী নদীর পূর্বতীরে সমবেত হন প্রায় ১০ হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা, যারা ১৪ ই সেপ্টেম্বর বালুরঘাটের ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত থানা এবং অনেক কয়েকটি প্রশাসনিক ভবনের দখল নিয়ে উত্তোলিত ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক সরিয়ে ভারতের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বালুরঘাট থানার দারোগা সহ সকলে পালিয়ে প্রান বাঁচায়। আন্দোলন কারীদের রোষানলে সেদিন বালুরঘাটে প্রায় ১৬টি অফিস ভস্মীভূত হয়েছিল। টেলিফোনের তার কেটে যানবাহন থেকে সড়ক সংযোগ, সবই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বালুরঘাট প্রথমবারের মত স্বাধীন হয় কিন্তু বালুরঘাট তিনদিন স্বাধীন থাকার পর বৃটিশ সরকার পুনরায় দখল নেয়। বালুরঘাটের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তাৎক্ষণিক সাফল্যের আগুন বালুরঘাটের আশেপাশের এলাকায় ছড়াতে দেরি হয়নি। দেখতে দেখতে ডাঙি, মদনাহার, তপন, লস্করহাট, পারিলাহাটে এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি পারিলাহাটে ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে আন্দোলন কারীদের খন্ডযুদ্ধ হয়, যেখানে মোট চার জন ভারতীয় শহীদ হন। অবশেষে পুলিশের অত্যাচারের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বালুরঘাট অভিযানের ১০ দিনের অধ্যায় সমাপ্ত হয়।

ব্রিটিশ সরকারের জোর পূর্বক খাজনা আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে বালুরঘাটের খাঁপুরে কৃষকরা এই অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। অর্ধেক নই, তিনভাগের একভাগ খাজনা হিসেবে গ্রহন করতে হবে সরকারকে। এই দাবিকে অস্ত্র করে ১৯৪৭- সালে ২০ ফেব্রুয়ারী প্রায় শতাধিক কৃষক মিছিলে বের হয়, মিছিলের দলটি এগিয়ে যেতেই ব্রিটিশদের পুলিশ বাহিনী মিছিলের উপর গুলি চালাতে থাকে। মোট ২২ জন কৃষক শহীদ এবং প্রায় ৫০ জন কৃষক পুলিশের গুলিতে জখম হন।

কিন্তু এত রক্তক্ষয় সংগ্রামের পরেও বালুরঘাট ১৫ আগষ্ট স্বাধীনতা লাভ করেনি। ১৫ আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা লাভের কালপঞ্জী ঘোষণা করা হলেও, বালুরঘাটের অস্তিত্ব পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে নাকি ভারতের সাথে যুক্ত হবে, তা নিয়ে বিড়াম্বনা দেখা দেয়। কেননা বালুরঘাট বাসিদের অন্তরে ভারতের সাথে যুক্ত হবার ইচ্ছা প্রবল ছিল, এবং সেই হিসেবে পাকিস্তানের সৈনিকদের বালুরঘাট ছেড়ে চলে যেতে হত ১৪ আগষ্টের মধ্যে। কিন্তু ১৪ অগাস্ট রাতে পাকিস্থানি সৈন্য বাহিনী ও পাকিস্তানি নেতারা বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ে হাজির হয় এবং সমস্ত কিছুর দখল নিতে থাকে। প্রায় গোটা বালুরঘাট ছেয়ে ফেলা হয় পাকিস্তানের পতাকায়। পরের দিন ১৫ অগাস্ট স্বাধীন পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বালুরঘাটে মহকুমা শাসক পানাউল্লা সাহেব পাকিস্তানের পতাকা তোলেন।

এই সময় ভারতের প্রতি ভালোবাসা সম্পন্ন বালুরঘাটের বেশ কিছু জায়গায় সাধারণ যুবক ও স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সশস্ত্র ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, এবং বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কুমুদরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় পাকিস্তানি পতাকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তুলতে বাধা দেন।

পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু স্থানে জনগনের এহেন প্রতিরোধে স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফ বালুরঘাট সহ বেশ কিছু এলাকাকে "নোশনাল এরিয়া" বলে ঘোষণা করতে বাধ্য হন। অবশেষে "নোশনাল এরিয়া" এর তকমা সরিয়ে দিয়ে ১৭ অগাস্ট বালুরঘাট সহ মোট পাঁচটি থানা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। তার ফলে পাকিস্তানি সেনাদের বালুরঘাট ছাড়তে হয় এবং ১৮ অগাস্ট সকালে বালুরঘাটে ভারতের সেনাবাহিনী প্রবেশ করে, এবং পাকাপাকি ভাবে ১৮ অগাস্ট বালুরঘাট ভারতের অংশ হিসেবে ভাবে স্বাধীনতা লাভ করে ও স্বাধীন বালুরঘাটে প্রথম সরোজরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় দ্বারা ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

WhatsApp

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন