মালদা জেলার মালদা শহর পশ্চিমবঙ্গের বুকে এক অনবদ্য জায়গা করে নিয়েছে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ফজলি আম, গম্ভীরা গান, হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের বড় ধরনের আবেগ, প্রাচীন থেকে বর্তমান পর্যন্ত সুবিস্তৃত ইতিহাস এবং তার ধ্বংসাবশেষ সব কিছু মিলিয়ে মালদা যেন আজ বাংলার সম্মান স্বরুপ। প্রাচীন থেকে বর্তমান পর্যন্ত সুবিস্তৃত ইতিহাসের আঁতুড়ঘর মালদা। তাই বর্তমানে ইতিহাস প্রেমি দর্শনার্থীদের জন্য মালদা এক অনন্য গন্তব্য। চলুন হালকা করে জেনে নিই সেই ইতিহাস।
প্রাচীন কাল:
মালদা ছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন নামের রাজ্যের অংশ, যেখানে মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য এবং পাল সাম্রাজ্য দ্বারা শাসিত ছিল। চন্দ্রগুপ্ত নন্দ বংশকে পরাজিত করলে মগধ তার দখলে চলে আসে, আর মালদা সে সময় তার অংশ ছিল। এরপর বিন্দুসার রাজত্ব করে। বিন্দুসারের পর সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের বিভীষিকা দেখে অনুতপ্ত হলে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন ও প্রচারে ব্রতি হন এবং তার সাক্ষ্য হিসেবে অনেকগুলো শিলালিপি তিনি খদিত করান। যার কয়েকটি মালদাতে রয়েছে, উদাহরণ স্বরূপ ঘোষরায়ন পিলার এবং মাহাশথাঙ্গার শিলালেখ।
আদিনা মসজিদের ইতিহাস জানতে ক্লিক করুন -> আদিনা মসজিদের ইতিহাস
এরপর গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে সমুদ্রগুপ্ত থেকে স্কন্দগুপ্ত সকলের সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে মালদা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতিহাসের প্রবাদ প্রতিম ব্যাক্তি পাণিনি তার গ্রন্থ "অষ্টাধ্যায়ী" তে গৌরপুরা নামের একটি শহরের উল্লেখ করেছেন, সম্ভবত সেটি মালদাতে অবস্থিত ছিল। এমনকি চীনা পরিব্রাজক জুয়ানজাং পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুন্ড্রনগর পরিদর্শন করেন যেটি ছিল গৌরপুরার পাশ্ববর্তী এবং তিনি এখানে অনেক স্তূপ ও মঠ দেখেছিলেন।
পরবর্তীতে পাল সাম্রাজ্যের সময়ে গোপাল পাল থেকে শুরু করে একে একে ধর্মপাল,দেবপাল, মহিপাল, রামপাল, সকলেই রাজত্ব করেছেন। পাল রাজত্বের আমলে মালদার গৌড় হয়ে উঠেছিল প্রাণকেন্দ্র। মালদার পাশ্ববর্তী বর্তমানে যেটি পাহাড়পুর সেটি পালযুগে সোমাপুর নামে পরিচিত ছিল, যা ধর্মপালের আরেক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে মহিপাল মালদার পাশ্ববর্তী অনেক এলাকায় কৃষকদের জন্য জলাধার তৈরি করেন। এছাড়াও দেবপাল তৎকালীন মালদার জগদ্দলে বৌদ্ধ মঠ তৈরি করেছিলেন। প্রথম মহিপাল আদিনায় একটি হিন্দু মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও পালযুগের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে, যেমন সন্ধ্যাকর নন্দির রামচরিতমানস, খালিমপুর তাম্রলিপি , তারানাথের লেখা থেকেও মালদার তৎকালীন অবস্থার কথা জানতে পারা যাই।
মধ্যযুগে মালদা:
মধ্যযুগে পাল রাজাদের পরাজিত করে মালদাতে সেন রাজবংশের উত্থান হয়েছিল, এবং এই সেন বংশের রাজারা ধর্মীয় দিক দিয়ে হিন্দু ছিল। লক্ষন সেন রাজা হয়ে তাদের রাজধানী মালদার গৌড়ে স্থানান্তর করেন এবং তার নাম অনুসারেই তিনি তার রাজধানীর নাম রাখেন লক্ষ্মণাবতী, সুতরাং আমরা বলতে পারি মালদার পূর্বের নাম ছিল লক্ষ্মণাবতী। লক্ষন সেন একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন যা বর্তমানে মালদার রামকেলিতে অবস্থিত।
মালদা জেলার কিছু ঐতিহাসিক স্থান |
কিন্তু ১২০৬ খ্রীঃ বখতিয়ার খিলজী বর্তমানের মালদা তৎকালীন লক্ষ্মণাবতীতে আক্রমন করলে লক্ষন সেন পালিয়ে গেলে সেন রাজত্ব শেষ হয় এবং মালদাতে মুসলিম শাসন শুরু হয়। বর্তমানে মালদাতে ছরিয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো মুসলিম আমলেই তৈরি যেমন- আদিনা মসজিদ, ছোটসোনা মসজিদ,বড়সোনা মসজিদ,ফিরোজ মিনার, লোটন মসজিদ, চিকা মসজিদ এবং দাখিল দরওয়াজা ইত্যাদি। এছাড়াও বখতিয়ারের আক্রমনে দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বের অংশ হিসেবে মালদা সংযুক্ত হয়, তার প্রমাণ স্বরুপ রয়েছে মালদার ফিরোজ মিনার যেটি তৈরি করেন সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ।
পরবর্তীতে মুঘল রাজারা প্রায় গোটা ভারতব্যাপী রাজত্ব কায়েম করলে মালদা তার অংশ হয় এবং মালদাতে শাহ সুজা দাখিল দারয়াজা তৈরি করেন।
প্রারম্ভিক আধুনিক সময়ের মালদা:
ষোড়শ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের দূর্বলতার সুযোগে বাংলার নবাব শক্তিশালী হয়ে উঠে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন মুর্শিদকুলি খান, যিনি মুর্শিদাবাদ শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং এটিকে তার রাজধানী করেছিলেন। কিন্তু মালদার প্রতি তার আনুগত্য ধরে রেখেছিলেন।
ঔপনিবেশিক সময়কাল থেকে স্বাধীনতা
১৮৫৭ সালে ইংরেজদের সাথে সিরাজদ্দৌলার পলাশীর যুদ্ধের পর মালদা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। মালদা ছিল ইংরেজদের প্রথম পছন্দ তাই ইংরেজরা তাদের প্রশাসনিক সদর দফতর সেই সময় মালদাতে নির্মাণ করেন, সেই স্থান বর্তমানে ইংরেজবাজার নামে পরিচিত, এমনকি তারা মালদায় একটি কোষাগার ও আদালতও খোলেন। কিন্তু বাংলার বিপ্লব থেকে কিছুটা রেহাই পেতে এবং প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে বাংলাকে কয়েকটি জেলা ও মহকুমায় বিভক্ত করে। যার ফলে মালদা প্রথমে দিনাজপুর জেলার অংশ তারপর পূর্ণিয়া জেলা, তারপর রাজশাহী বিভাগের সাথে যুক্ত হয়, কিন্তু ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর, মালদা ভারতের সংযুক্ত হয়, এবং স্বাধীনতার পর মালদা আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৮১ সালে একটি পৃথক জেলা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। WhatsApp FINDING HISTORY BY ME
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন