শিলচাগুড়ি শিলিগুড়ি
শিলিগুড়ি শহরের ইতিহাস বেশ ঐতিহ্যবাহী ও রোমাঞ্চকর। তিস্তা, মহানন্দা, বালাসন, জলঢাকা নদী দ্বারা ঘিরে রাখা একটি সুন্দর শহর। পাহাড়ী নদী, সমতলীয় নদী শিলিগুড়িকে যেমন সৌন্দর্য প্রদান করেছে , তেমনি জীবনের রুপরেখা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা গ্রহন করেছে। বলাবাহুল্য পাহারের পদতলে থাকা শিলিগুড়ি একসময় নুড়িপাথরে ভরা জঙ্গলময় সমতল ভূমি ছিল। তাই এই অঞ্চলটি পূর্বে শিলচাগুড়ি নামে পরিচিত ছিল। যার অর্থ নুড়িপাথরের ঢিবি। এই শিলচাগুড়ি নামটি আজ শিলিগুড়ি নামে পরিচয় লাভ করেছে। নামটি কোন জাতিরা দিয়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। একটি মতামত হল যে, এই নামটি ভুটানিরা দিয়েছে। ভুটানিরা এই স্থানকে শিলচাগুড়ি বলতেন, যার অর্থ হল শিলা বা পাথরের গুড়ি। একটি অন্য মতামত হল যে, এই নামটি ব্রিটিশরা দিয়েছে।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
এই শহরটি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন রাজ্য, সংস্কৃতি ও বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এত মনোরম আবহাওয়া যুক্ত, সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ, উর্বর ভূমি সর্বপরি তিন দিক দিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান দেশের সাথে খুব সহজেই সংযোগ স্থাপন, উত্তর পূর্ব ভারতের প্রবেশের জন্য প্রবেশ পথ এছাড়াও আরো কয়েকটি দিক রয়েছে যার দরুন শিলিগুড়ি ভারত তথা বিশ্বের কিছু দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে পরিচয় পেয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই শিলিগুড়িকে দখলের চেষ্টা আগেও দেখা গিয়েছে এবং এখনো দেখা যাচ্ছে।
সেবকের ঐতিহ্য বাহী করোনেশন ব্রিজ |
পূর্বে সিকিম যখন ভারতের অংশ ছিল না তখন সিকিমের চোগিয়াল রাজা শিলিগুড়ি কে দখলে ছিল। এই সময় ১৭৭৫ সাল থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যে নেপাল থেকে বহু নেপালি সিকিমে প্রবেশ করতে শুরু করে যার তীব্র বিরোধিতা করে সিকিম সরকার। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশরা সিকিমের কাছে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় এবং যার ফলে গোর্খা নেপালিরা হয়ে উঠে ব্রিটিশ এবং সিকিমের কমন শত্রু। নেপালিরা ইতিমধ্যে শিলিগুড়ির পার্শ্ববর্তী এলাকা দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু ১৮১৬ সালে ব্রিটিশ নেপাল যুদ্ধ হলে , নেপাল পরাজিত হয় এবং সৌগলির চুক্তি করে এবং দখলকৃত জায়গা শিলিগুড়িকে ফিরিয়ে দেই। ব্রিটিশদের ক্ষমতা এবং প্রভাব সিকিমের উপর দিন দিন বাড়ছিল। ব্রিটিশরা সুযোগ বুঝে একসময় তারা দার্জিলিং এ আধিপত্য বিস্তার করে। এতে শিলিগুড়ির দায়ভার চলে আসে ব্রিটিশ সরকারের হাতে। এই শিলিগুড়ি থেকে ব্রিটিশরা তাদের ব্যবসায়িক সামগ্রী পাহাড়গুলোতে রপ্তানি করতে শুরু করে।
রেলগাড়ি সংযোগ
ব্রিটিশরা প্রধানত শিতপ্রধান দেশের নাগরিক ছিল পাশাপাশি চায়ের চাহিদা ব্রিটেন সহ গোটা বিশ্বে বাড়ছিল। সুযোগ বুঝে শিলিগুড়িকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশরা দার্জিলিং শহরকে দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে তৈরি করে। যার ফলস্বরূপ দার্জিলিং যাতায়াত এবং চা পাতা পরিবহনের জন্য ব্রিটিশদের শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং প্রযন্ত রেল ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য করে ১৮৭৮ সালে এবং শিলিগুড়ি শহরটি গড়ে তোলা হয় শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন (একমাত্র হেরিটেজ রেলষ্টেশন)। এই ষ্টেশনে বহু বিখ্যাত ভারতীয় স্মৃতি বহন করে রেখেছে, যেমন - মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঘা যতিন প্রমূখ। আবার ১৮৮০ সালে ন্যানো গ্যাজের রেলওয়ে ব্যবস্থা চালু করা হয়, যা এখনও হিমালয়ান রেলওয়ের ট্রয় টেন হিসেবে বিখ্যাত, এবং এটিও বিশ্ব হেরিটেজ হিসাবে নথিভুক্ত।
শিলিগুড়ি টয় ট্রেন |
চিকেন নেক
ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাবার আগে ভারতের বৃহৎ ভূ-খন্ডকে ভারত এবং বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) হিসেবে সিরিল রেডক্লিভ শিলিগুড়ির উপর দিয়ে বয়ে চলে যাওয়া মহানন্দা নদী যেখানে বাংলাবান্ধা পার করেছে সেখান থেকে নদীর এপার ভারত এবং ওপার বাংলাদেশ হিসেবে ভাগ করেন। যার ফলে শিলিগুড়ির একপাশে নেপাল অন্যপাশে বাংলাদেশ থাকার ফলে উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে সমগ্র ভারতের ভূ যোগাযোগের খুবই পাতলা সরু করিডোরের তৈরি হয়েছে, যেটি আজ শিলিগুড়ি চিকেন নেক করিডর হিসাবে পরিচিত। মূলতঃ যে কোনো দেশ এই স্থানটি দখল করলে ভারতের মূল ভূ-খন্ডের সাথে উত্তর পূর্ব ভারতের যোগাযোগ নষ্ট হতে পারে। সুতরাং ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই করিডোরের গুরুত্ব অসীম।
আরো পড়ুন - বালুরঘাটের ইতিহাস: প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগের এক শহর।।
তবে এত কিছুর পরেও শিলিগুড়ির অগ্রগতিতে বাধা পরেনি। যার দরুন ১৯৯৪ সালে শিলিগুড়িতে মিউনিসিপাল কর্পোরেশন তৈরী করে ফেলে নগর সৌন্দর্যায়ন প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন