আদিম আদিবাসী (প্রিমিটিভ) বা আদিবাসী উপজাতি (সেডুল ট্রাইব) এক বস্তু যে নই, সেই অস্পষ্ট ধারনা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে আদিবাসীর প্রকৃত সংজ্ঞা প্রসঙ্গে, আদিবাসী বিষয়ে দুই ধরনের সংজ্ঞা পাওয়া যায়। একটি আভিধানিক সংজ্ঞা এবং অন্যটি জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) কর্তৃক নির্ধারিত সংজ্ঞা। অভিধানিকভাবে আদিবাসী শব্দের অর্থ দেশি, স্বদেশজাত বা ভূমিপুত্র। উল্লেখ্যযোগ্যভাবে মাহালি এবং সাঁওতাল উভয়ই তপশিলি উপজাতির অংশ, I.L.O (International Labour Organization) ১৯৫৭ ও ১৯৮৯ এর অধিবেশন কালিন আদিবাসী ও উপজাতির মাঝে পার্থক্য নিরুপনের চেষ্টা করেছিল,যা উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে মিহি পার্থক্যের সূত্ৰপাত ঘটাই-নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস বা অধিকৃত হওয়ার বা উপনিবেশ সৃষ্টির পূর্ব থেকে বসবাস করা। বাকি শর্তগুলো মোটামুটি একই রকম।
প্রাচীন ভারতের নৃতাত্ত্বিক
নৃতত্ত্ব দিক দিয়ে উত্তম মাপকাঠি হিসাবে - ১ দেহে গঠন, ২ গায়ের রং, ৩ করোটির আকৃতি, ৪ মুখের গঠন, ৫ রক্তের বিভাগ, ৬ নাকের আকার, ৭ চোখের রং ও আকার , এবং ৮ মাথার চুলের রং ও বৈশিষ্ট্য ধরা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘকালিন বিভিন্ন জাতির মিশ্রনের সেই বৈশিষ্ট প্রায় লুপ্ত। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের চড়ম প্রভাবে এই মিথোস্ক্রিয়া চড়ম আকার ধারন করেছিল। ১৯০১ সালে ভারতে বিভিন্ন জাতির প্রথম নৃতাত্ত্বিক পরিমান নির্ধারনের প্রচেষ্টা গ্রহন করা হলেও, পূৰ্বেই এর সূচনা হয়েছিল যেখানে ব্রাহ্মন বাদে সকল জাতিকে উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর ও অন্ত্যজ সংকরে ভাগ করা হয়, যেটি "বৃহৎদ্ধর্ম" নামের পুরাণে বলা হয়েছে, যেখানে 'সংকর' শব্দটি এবং এছাড়াও পুরাণে অনুলোম এবং প্রতিলোম বিবাহের কথা বলা হয়েছে, যেটি প্রমান করে যে বর্তমানে ভারতের কোনো জাতি তার নিজের প্রকৃত অবস্থায় আর নেই।
প্রোটো অষ্ট্রলয়েড ও দ্রাবীড়িয়ানের ক্ষুদ্র পার্থক্য |
বলাবাহূল্য মাহালী ও সাঁওতাল উভয়ই আদিবাসী উপজাতি বিশেষ এবং উভয়ই একে অপরের থেকে পৃথক এবং পৃথক জীবনশৈলির দ্বারা পরিচালিত কিন্তু পরিবর্তনশীল সমাজের সহজাত আদান-প্রদান, মিথোস্ক্রিয়া এমন ভাবে দুই উপজাতিকে একসূত্ৰে গেঁথে দিয়েছে যা বিচ্ছিন্ন করা কোনো মতে সহজসাধ্য নই। সাঁওতাল জনগোষ্ঠির সংখ্যাগরিষ্ঠতা মাহালি উপজাতি থেকে বেশি। রিজলের দ্বারা পরিচালিত তার জাতি ভিত্তিক গবেষণা তার কিতাব "কাষ্টস এন্ড ট্রাইবস অব বেঙ্গল" এ লিপিবদ্ধ করেছেন, ডঃ জেমস উইস তার দীর্ঘ কালিন বাংলার আদিবাসীদের জীবন যাত্রা লক্ষ্য করে এসেছেন তার বহু আগে থেকে।
সাঁওতালদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট
সাঁওতাল অষ্ট্রিক গোষ্ঠির প্রোটো অষ্ট্রোলয়েড সমূদায়ে পরে। অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসিদের সাথে এদের মিল রয়েছে। পুরাণে বলা 'নিষাদ' জাতির সাথে এদের মিল পাওয়া যায়, পূৰ্বে এই সাঁওতাল জাতিকেই 'খেরওয়াল' জাতি হিসাবে অভিহিত করা হত। অষ্ট্রাল জাতির অংশ হিসাবে স্বাভাবিক ভাবেই এদের করোটি অপেক্ষাকৃত মাঝারি, এবং কায়িক দিক দিয়ে বেঁটে, কালো বর্ণের হয়ে থাকে, এবং যথার্থ ভাবে রক্তের বিভাগ হিসাবে 'O' এর আধিক্য দেখা যায়। খেরওয়ার জাতির অংশ হিসাবে অনেকেই সাঁওতালদের হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বর্নিত অসুর দের অংশ হিসাবে মনে করেন। যাইহোক সাঁওতাল জনগোষ্টি ভারতীয় উপ মহাদেশের অন্যতম আদিবাসি সম্প্রদায়, যাদের নিজেস্ব সংস্কৃতি ও বিরাসত রয়েছে, সাংগঠনিক ভাবে সাঁওতালদের বৃহৎ অংশ বিভিন্ন ধর্ম এবং সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে তার নিজের সংস্কৃতির অনেকখানি বিচূতি ঘটিয়েছে। সাঁওতালদের বিবাহ প্রথা যেটি বাপলা শব্দে পরিচিত সেটি বিবিধ ~ কিরিং বাপলা, রাজারাজি বাপলা, সাঁদাই বাপলা, গুনাইটি বাপলা, সাঁঙ্গা বাপলা, বিবিধ। এই বিবিধ বিবাহ পদ্ধতির একটি ব্যতিত সকল বিবাহ প্রথা নারি স্বাধিনতার ইঙ্গিত দেই, যার একটি হল বিধবা বিবাহ বা গুনাইটি বাপলা।
সাঁওতাল জনগোষ্ঠী |
মাহালীদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট
অষ্ট্রিক জাতিগোষ্টির পর দ্রাবীড় ভাষার ব্যবহার কারি নরগোষ্ঠীদের সারি চলে আসে, রিজলে মাহালীদের তার নৃতাত্ত্বিক মাপকাঠির উপর ভিত্তি করেই দ্রাবিড়ীয়ান হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। দ্রাবিড়ীয়ানের অংশ হিসাবে মাহালিদের সাথে আদিম মিশরিয়দের সাথে মিল পাওয়া গেলেও বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণিত 'পনি' নামক জনগোষ্ঠীর সাথে এদের মিল রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। মাহালিদের গৌত্র প্রচুর রয়েছে, যেমন - বেরা, কারুকুশা, মান্ড্রী, ডুমরি, হেমরম, সরেন,কাউরিয়া,তিরকী,মুন্ডা আরো বিবিধ। মাহালীদের নৃতাত্ত্বিক মাপকাঠির বিচারে স্বাভাবিক ভাবেই মাঝারি অবয়ব , অপেক্ষাকৃত লম্বা করোটি, গায়ের বর্ণ কালো, ছোটো নাকের অধিকারী। মাহালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে 'B' বিভাগের রক্তের প্রবণতা বেশি রয়েছে। শুধু মহান বিদ্যান হার্বাট রিজলে নন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং আদিবাসী বিষয়ক গবেষক জনাব সালেক খোকন মাহালীদের দ্রাবিড়ীয়ান হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং ১৯৩১ সালে জনগননায় নিযুক্ত কমিশনার হাটন সেটি অাক্ষরিক অর্থে অনুমোদন করেছিলেন।
মাহালী সম্প্রদায় |
সাঁওতাল ও মাহালীর মেলবন্ধন
বিবিধ সময়ের ধারাবাহিক মেলবন্ধন মাহালিদের আজ মিশ্রজাতিতে পরিবর্তন করেছে। চন্দ্রিলের কথাই বাঘ (tiger) ও শিংহের (lion) মিশ্র রুপ যেমন tilon, ঠিক তেমনটাই ঘটেছে সাঁওতাল এবং মাহালী উভয়ের ক্ষেত্রেও। সাঁওতাল এবং মাহালী উভয়েই নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে আলাদা, কিন্তু কিছু কিছু বিদ্যান ক-জন (হস্ত কর নির্নায়ক) শুধুমাত্র কিছু গৌত্র ভিত্তিক মিল এবং কিছু কিছু স্থানের মাহালীদের ব্যবহৃত ভাষার সাথে সাঁওতাল ভাষার মিল থাকার সুবাদে মাহালীদের সাঁওতালদের অংশ হিসাবে বর্ননা করে থাকে। কখনো কখনো এই মিলন-শৈলি ধারনার বশীভূত হয়ে অনেক পন্ডিতই মাহালীদের সাঁওতালের অংশ হিসাবে প্রোটো অষ্ট্রোলয়েড মনে করেন। যদি গৌত্রগত এবং ভাষাগত মিলকেই নৃতাত্ত্বিক মাপকাঠি ধরে নেওয়া হয় তবে সেই দিক দিয়ে বিচার করলে মাহালীদের গৌত্রের বড় অংশ ওড়াঁওদের গৌত্রের সাথে মিল রয়েছে, এবং মাহালীদের সবথেকে বড় অংশটিই সান্দরি ভাষাই কথা বলে, নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে এরাই আবার দ্রাবিড়ীয়ান।সুতরাং ভাষাগত এবং গৌত্রগত মিলের উপর নির্ভর করে মাহালীদের সাঁওতালদের অংশ মনে করা একপ্রকার বোকামি। যেখানে মাহালীদের জোরপূৰ্বক বিয়ে নেই, সেখানে এই পর্বটি সাঁওতালদের মাঝে এখনো রয়েছে।
সাঁওতালদের সাথে মাহালীদের এই অস্বাভাবিক মিল একদিনের ফসল নই, মহেঞ্জোদারোর খননকার্যই এর প্রমান দিয়ে থাকে, মহেঞ্জোদারোতে প্রোটো অষ্ট্রোলয়েড এবং দ্রাবিড়ীয়ান উভয়েরই কঙ্কাল পাওয়া গেছে, সুতরাং প্রোটো অষ্ট্রোলয়েডের প্রতিনিধি সাঁওতালদের সাথে দ্রাবিড়ীয়ানদের প্রতিনিধি মাহালীর সহবস্থান, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ও মিথোস্ক্রিয়া সেই প্রাচীন কাল থেকেই রয়েছে, এমনাবস্থায় ভাষাগত এবং ব্যবহারিকগত মিল থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে উভয়ের মধ্যের রক্তের বিভাগ গত পার্থক্য থাকলেই মাহালী আর সাঁওতালদের মধ্যে যে একি হৃৎস্পন্দন স্পন্দিত হয় তা প্রশংসার যোগ্য। আদিবাসীর দুই প্রতিনিধি হিসাবে উভয়েই একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসবে এটাই কাম্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন