এ যেন এক অন্য প্রেম কাহিনি, জেদ না পাগলামো বলা মুশকিল, তবে নিঃসন্দেহে অষ্টম অাশ্চর্যের তকমা দেওয়া যেতে পারে। মুঘল বাদশা শাহজাহান তার প্রিয় পত্নির জন্য তাজমহল বানিয়ে ছিলেন, আজ যা সপ্ত আশ্চর্যের একটি। শাহজাহানের যশ ,ক্ষমতা, অর্থ সবকিছুই ছিল তার করায়ত্তে, তার পাশাপাশি ছিল শিল্পের প্রতি গভির আকর্ষন। কিন্তু অন্যদিকে এই দলিতের না ছিল অর্থ, না ছিল যশ, না ছিল ক্ষমতা, যা অসম্ভবকে সম্ভব করতে বাধ্য করেছিল তা ছিল তার পত্নির পতি গভির ভালোবাসা যা পরিনত হয় অদম্য জেদে। "যতক্ষন পারবো না, ততক্ষন ছাড়বো না" তা সে যত বড়ই বাঁধা আসুক, হোক না কেনো তা পাহাড় সমান, লড়ে চলেছি- লড়েই যাবো, আবারো সেই একি জেদ "যতক্ষন পারবো না,ততক্ষন ছাড়বো না"। কিন্তু এখানে বাঁধা পাহাড় সমান নই, বাঁধা যে নিজেই একটি পাহাড়, যার নাম "গেহলৌর" অবস্থান বিহারের গয়াতে।
দশরথ মাঝি "দা মাউন্টেন ম্যান" |
আশ্চর্যের প্রেম কাহিনি
আবার এই গেহলৌর পাহাড়ের পাশেই আদিবাসী দলিত সমাজের ছোট্ট গ্রাম, পাহাড়ের নামেই এর নাম হয়েছে "গেহলৌর"। এই গ্রামেই জন্মেছিল স্বর্গীয় দশরথ মাঝি (১৯৩৪ খ্রিঃ)। দুরন্ত জেদি, প্রথা অনুযায়ী বাল্যকালেই তার বিয়ে হয়েছিল গ্রামের এক মেয়ে ফাল্গুনির সাথে, কিন্তু জেদি ছেলে বলে কথা বাড়ি ছেড়েও পালিয়েছিলেন একবার, পালিয়ে গিয়ে ধানবাদের একটি কয়লাখনিতে কাজ করেন বহুদিন। নিজের গ্রামে ফিরে এসে গ্রামেরি সেই বাল্যকালের মেয়ে সেই ফাল্গুনী দেবির সাথে প্রেমের সম্পর্কে জরিয়ে পরেন যুবক দশরথ, শেষে সেই প্রেমের পরিনতি হিসেবে বিয়েও হল তাদের, খুব শীঘ্রই পিতা হলেন দশরথ। স্বর্গীয় দশরথ মাঝির একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল , নাম ভাগীরথ মাঝি এবং বাসন্তী মাঝি।
গেহলৌর পাহাড়
ফাল্গুুনি দেবির প্রতি যুবক দশরথের ভালোবাসা ছিল অগাধ, কিন্তু সেই ভালোবাসাই আঘাত হানল একটি প্রকান্ড পাহাড়। দশরথের গ্রামের উন্নয়নের প্রধান বাধা ছিল এই গেহলৌর পাহাড়, কেননা তাদের গ্রাম থেকে পাশের শহর ওয়াজিগঞ্জের সরলরেখা হিসাবে যে দূরত্ব ১৫ কিমি, কিন্তু মাঝের এই গেহলৌর পাহাড় থাকাই সেই দূরত্ব হয়ে দ্বারাই ৫৫ কিমি। একদিন খাবারের জল আনতে গিয়ে ফাল্গুনি দেবীর এই পাহাড়ের মাঝে পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হন, সেই সময় ফাল্গুনি দেবীকে পাশের শহরের হসপিটালে নিয়ে যাবার প্রয়োজন পরে, কিন্তু মাঝে গেহলৌর পাহাড়, সেই সময় গাড়ীর সঠিক ব্যবস্থা না থাকাই এই পাহাড়ের উপর দিয়েই নিয়ে যেতে হল ফাল্গুনি দেবীকে, কিন্তু শেষ রক্ষা আর হল না। গেহলৌর পাহাড় পার করে হসপিটালে আসতে তাদের যা সময় লেগেছিল, তা যথেষ্ট ছিল না ফাল্গুনি দেবীকে বাঁচানোর জন্য।
আরো পড়ুন- বিখ্যাত কিছু আবিষ্কার, যা ভারত থেকে চুরি করা হয়েছে
স্বর্গীয় দশরথ মাঝির পাহাড় জয়দশরথ মাঝি রোড
প্রিয়তম পত্নি ফাল্গুনিকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পরেন যুবক দশরথ। প্রতিঙ্গা করেন এমন ভয়ঙ্কর হাল হতে দেবেন না কারো, কারো মৃত্যর কারন হতে দেবো না এই পাহাড়কে। বাড়ীর একজোড়া ছাগল বিক্রী করে বাজার থেকে কিনে আনলেন একটা হাতুড়ি আর ছেনি, আর নিজের অদম্য ইচ্ছার উপর ভর করে একাই লেগে পরলেন পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরিতে।
প্রথমে দশরথের এই কাজে গ্রামের সকলে তাকে পাগল বলে আখ্যা দিয়েছিল, মাঝে বহুবার এসেছে নানান বিপদ, কিন্তু দশরথ মাঝি থেমে থাকেন নি একবারো। দীর্ঘদিনের পাহাড়ের সাথে ঐকিক যুদ্ধের কাহিনি এই প্রকান্ড কর্মকান্ড ধিরে ধিরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে চারে দিকে, পরিচিতি বাড়তে থাকে দশরথের, পরিচিত হলেন "মাউন্টেন ম্যান" নামে । শেষে দীর্ঘ বাইশ বছর পর তার এই বিশাল কর্মকান্ডের ফল হিসাবে গেহলৌর পাহাড়ের বুক চিরেই তৈরি হল ১১০ মিটার দীর্ঘ, ৯.১ মিটার প্রস্থ ও ৭.৬ মিটার গভীরতা সম্পন্ন রাস্তা এবং মহূর্তেই ৫৫ কিমি থেকে কমে মাত্র ১৫ কিমিতে পরিণত হল।
স্বর্গীয় দশরথ মাঝির স্মৃতি
স্বর্গীয় দশরথ মাঝির অদম্য জেদ ও ভালোবাসার গল্প এখন জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রেও, তার জিবনী যেন হয়ে দাড়াঁই একটি বিশেষ উদাহরণ। বিহার সরকার তাকে যোগ্য সম্মান দেবার চেষ্টা করেনি বললে হইতো ভুল হবে, কারন বিহার সরকার পদ্মশ্রীর জন্য ভারত সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল বিহার সরকার (২০০৬), এমনকি তার নামে ছাপানো হয় ডাক টিকিট। বিহার সরকার তার বীর ভূমিপুত্র স্বর্গীয় দশরথ মাঝির জন্য জমি দিয়েছিলেন একবার, কিন্তু দশরথ মাঝি গ্রামের উন্নতিকল্পে সেই জমিটুকুও দান করে দিয়েছেন হসপিটাল তৈরির জন্য, এখন সেই জমিতে তার নামে তৈরি হয়েছে হসপিটাল। একি সাথে যে রাস্তা তিনি তৈরি করেছিলেন তার নামও রাখা হয় দশরথ মাঝি রোড।
দেখতে দেখতে স্বর্গীয় দশরথ মাঝির চরিত্রটি জায়গা দখল করে চলচ্চিত্র জগতেও, তার জিবনী নিয়ে "মাঝি দা মাউন্টেন ম্যান" বক্সঅফিসে বেশ ভালোই ফল করেছিল(২০১৫), এমনকি আমির খান তার জিবনীতে প্রভাবিত হয়ে "সত্যমেব জয়তে" নামক দুরদর্শন অনুষ্ঠানে একটি পর্ব তৈরি করেন।
বিহারের দলিত এই বীর ভূমিপুত্র ২০০৭ সালে ৭৩ বছর বয়সে দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস (AIIMS) এ কর্কটরোগের চিকিৎসা কালিন মারা যান,বিহার সরকার এই ভূমিপুত্র রাজকীয় ভাবে স্বর্গীয় দশরথ মাঝির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন