মালপাহাড়ি বা মাল পাহাড়ীয়া
নানা জাতী উপজাতীতে পরিপূৰ্ণ আমাদের এই ভারতবর্ষ, তাদের মধ্যে
মাল পাহাড়ীয়া বা মাল পাহাড়ি একটি বিশেষ ভারতীয় উপজাতীয় লোক, প্রধানত পাহাড়িকা উপগোত্রিয়দের একটি। প্রায় বিচ্ছিন্ন, ভবঘুরে জিবনী এদের, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে লড়ে চলেছে এই জাতি। "মালপাহাড়ী" নামেই তাদের প্রাচীন জীবনযাত্রার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ঝাড়খন্ড রাজমহল পাহাড় এদের আদি বাসস্থান, তবে বাংলাদেশ , বিহার, পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চলে এবং ঝাড়খন্ড রাজমহল পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে এদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যাই এবং বর্তমানে এই এলাকাটি ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনা বিভাগ নামে পরিচিত।
মাল পাহাড়ি জাতির লোকেরা বড্ড অরন্যপটু, সমতল কিংবা আধুনিক সমাজ থেকে দূরে থাকার প্রবণতা অগ্রগতির পথে বাধা প্রাপ্ত হয়েছিল, পাহাড় থেকে সমতলে এনে তাদের চাষ বাস করে জীবন অতিবাহিত করার সুযোগ ব্রিটিশ আমলেও প্রদান করা হয়েছিল, কিন্তু স্বভূমি পাহাড় ছাড়তে নাড়াজ, কালক্রমে সাঁওতালদের সাথে বিরোধ বেঁধেছিল স্বভূমির অধিকার নিয়ে। কিন্তু অবশেষে তাদের বিচরণ সমতলেও নেমে আসে।
জাতী পরিচয়
দ্রাবীড়কূল এই আদিবাসী সম্প্রদায় একদা পাহাড়ের উপর নির্ভরশীল ছিল, পাহাড়ের গাঁ বেয়ে নামা নদি, মধু ও জঙ্গলের কাঠ হয়ে উঠেছিল জীবন নির্ধারণের জীবিকা, তবে কালক্রমে এখন চাষবাস, দৈনিক মজুরি, বিভিন্ন পেশাই অংশগ্রহন করতে দেখা যায়। বিগত ২০১১ সালের আদমশুমারি জনগণনাই গোটা ভারত ব্যাপি প্রায় ১,৮২,৫৬০ জন মাল পাহাড়ীদের বাস, যার মধ্যে ১,৩৫,৭৯৭ জন রয়েছে ঝাড়খন্ডে, পশ্চিমবঙ্গে ৪৪,৫৩৮ জন, এবং বিহারে রয়েছে খুবি অল্প মাত্রাই প্রায় ২,২২৫।
মাল পাহাড়ীয়া জাতি |
আরো পড়ুন - আদিবাসী কাদের বলে ,কেন বলে?
যাইহোক, মালপাহাড়ীরা দ্রাবীড়কূল হওয়াই দ্রাবীড় ভাষার মিশ্ররুপ "মাল্টো" ভাষাই কথা বলে, পাশাপাশি এটাও বলতে হবে যে বাংলা, হিন্দি, এককথাই বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি দ্রাবীড়, ইন্দো-আর্য ভাষা হওয়াই এই ভাষাটি খুব দুর্বল ভাষাই পরিণত হয়েছে। যেমনটা সৌরিয়া মালপাহাড়ি ভাষাই দেখা যাই, সাঁওতাল শব্দের বহুল প্রচলন।
সাহসী জাতি হিসাবে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বর্তমানে পাহাড়ীয়ারা দূৰ্বল, এবং বিলুপ্ত প্রধান জাতির জন্য অনবরত নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া এই জাতি, বাস্তবিকভাবেই লড়াকু, যার দরুন ইংরাজরাও হার মেনেছিল এদের কাছে, সাঁওতাল অনুপ্রবেশে সামনা সামনি বিরোধিতাই দাঁড়িয়েছিল শক্তভাবে।
পূৰ্বে পাহাড়ে বসবাসকারি এই মাল পাহাড়ি সমাজ দ্বারা নির্বাচিত "সর্দার" দ্বারা পরিচালিত হতো। বাংলায় মুসলিম শাসনকালে মাল পাহাড়ীয়ারা সমভূমির জমিদার দ্বারা স্বাধিনতা হরণে উঠে এলে, জমিদারদের পৃষ্ঠপোষক ইংরাজদের সাথে পাহাড়িয়া সর্দারদের যুদ্ধ হয়েছিল ১৭৭০ সালে, কিন্তু পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে মাল পাহাড়ীয়াদের শায়েস্তা করতে গিয়ে ইংরাজদের শক্তিই ক্ষুন্ন হয়ে পরেছিল।
যার পরিণতি হিসাবে ১৭৭৮ সালে ব্রিটিশরা মাল পাহাড়িদের সাথে আপোষ করাই যুক্তিযুক্ত মনে করে, যার দরুন "প্যাসিফিকেশন" প্রকল্পের আওতাই প্রস্তাব দেয় অর্থ এবং দক্ষলকরা পাহাড়ের জমিগুলি মাল পাহাড়ী সর্দারদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি মাল পাহাড়ীয়াদের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে ব্রিটিশরা নিজ সেনা বাহিনীতে মাল পাহাড়ীয়াদের একটি রেজিমেন্ট পর্যন্ত তৈরি করেছিল।
সাঁওতালদের সাথে বিরোধ
১৮০০ সালের দিকে ব্রিটিশ শক্তি মাল পাহাড়ীয়াদের কায়িক দক্ষতাকে কাজে লাগাতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করেছিল, যেখানে মাল পাহাড়ীয়াদের কৃষিকর্মে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সমভূমিতেও তাদের বসতি স্থাপনের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাতে সাফল্য না এলে সাঁওতালদের সেই কাজে বেছে নেওয়া হয় এবং পাহাড়ের ঢালে সাঁওতালদের অবাধ বসতি স্থাপনে ইংরাজরা সহযোগি হয়ে উঠে, যার দরুন সাঁওতালদের সাথে মাল পাহাড়ীয়াদের বিরোধ বাঁধে, যা সংঘর্ষের রুপ নিতে শুরু করেছিল, অবশেষে ব্রিটিশদের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের বিরোধের সমাপ্তি ঘটে এবং অবশেষে, তাদের এই অঞ্চলটি সাঁওতাল পরগনা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। এই এই অঞ্চলটিই সাঁওতাল পরগনা নামে ২০০০ সালে ঝাড়খণ্ড রাজ্য সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিটের বিভাগে পরিণত হয়।
মাল পাহাড়ি মহিলা |
বিচ্ছিন্ন জাতী
সহজ সরল জীবন যাপনে ব্যাস্ত এই আদিবাসী সমাজ, আজ ভারতের বুকে একেবারে কোন ঠাঁসা হয়ে পরেছে, তা সরকারের জন-গণনাতেই বোঝা ষায়, তাদের খাদ্যভাস পরিবর্তন, রিতিনিতি পরিবর্তন, এমনকি ভাষার বিকৃতিকরণ ঘটেছে, পাশাপাশি শিক্ষাগত দিক দিয়েও অনেকটাই পিছিয়ে পরেছে এই সমাজ, মাত্র ১% শিক্ষিত সমাজ নিয়ে বাস মাল পাহাড়ীয়াদের। কেন জানি ! আজ পাহাড়ীরা তাদের নিজস্ব জমিতে তুচ্ছ সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। পরিচয় বিহীন, প্রায় একপ্রকার সকল সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত এই জাতির যতজনের সাথে পরিচয় ঘটেছে ,তারা জন্মসুত্রে সকলে আদিবাসী পরিচয় বহন করলেও সরকারি মান্যতাপ্রাপ্ত আদিবাসী শংসাপত্র তাদের নেই, যদিও পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের সরকার তফসিলি উপজাতি হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে। বিতর্ক রয়েছে, তবে সেই বিতর্ক নিজেদেরই সৃষ্টি বলেই মনে হয়। মাল পাহাড়ীদের স্বকীয় পদবী পুঝোড়, মালপাহাড়ী, ব্যাতীত নিজের আত্মপরিচয়ের অবলম্বন হারিয়ে রাই, মন্ডল, পদবি ধারিদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছি আমার পার্শ্ববর্তী এলাকাই। এমনাবস্থাই আদিবাসী আত্মপরিচয় হীন এই জাতীসকল সরকারি সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে এটা অনুমিত। আবার পাশাপাশি আমি যা লক্ষ্য করেছি, মাল পাহাড়ীয়াদের বেশীর ভাগ লোকেদেরই আদিবাসী শংষ্যাপত্র নেই, শুধু পরিচয়েই আদিবাসী প্রমানে নেই।
পাহাড়ীয়াদের সেই অংশ যারা দামিন-ই-কোহ নামক স্থানের দক্ষিণে এবং সাঁওতাল পরগনার দক্ষিণ এবং পূর্বে বাস করে তাদের হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যে অনেকেই বাংলা মিশ্রীত ভাষায় কথা বলে, তবে অন্যদের সাথে তারা বাংলা ও হিন্দিও বলে। তবে মাল পাহাড়ীদের বেশির ভাগ অংশ হিন্দু ধর্মই গ্রহণ করেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন