ছায়াছবি সমাজের আয়না, সুতরাং ছায়াছবিতে প্রতিফলিত হয় সমাজের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি। কিন্ত বাধ সাধলো পরিস্থিতির বাস্তবিক সত্যতা নিয়ে। ঠিকই ধরেছেন, আমি বলছি দ্য কেরালা স্টোরি বিতর্ক নিয়ে। এর আগে এমন বিতর্ক উঠেনি তাই না, এর আগেও দ্য কাশ্মির ফাইলস, এক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার, ফায়ার, পারজানিয়া, আন্ধী, ফিরাক, ওয়াটার, বেন্ডিট কুইন, এছাড়া আরো প্রচুর ছায়াছবি রয়েছে যেগুলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। যার মধ্যে কিছু ছায়াছবিকে ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিষদ দ্বারা বেন করা হয়েছিল, কেননা চলচ্চিত্রের কিছু বিষয়বস্তু ভারতের কোনো না কোনো এক বিশেষ ভাবধারাকে আঘাত করেছিল। আবার কিছু কিছু চলচিত্র এমন রয়েছে যেগুলো অনেকের মতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিশেষ সম্প্রদায়ের ওপর নেতিবাচক ধারণা বিস্তারের উদ্দেশ্যে। আর এমনি আরেকটি চলচ্চিত্রের সংযোজন হল দ্য কেরালা স্টোরি। বিতর্কের কারণ
মাত্র ২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের ট্রেলার মুক্তির পরই চলচ্চিত্র ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্কের ঝড়। রাজনৈতিক মহল সহ গরমাগরম হয়ে উঠে বেশ কিছু রাজ্য। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বেশ কিছু রাজ্য বেন করে দিয়েছে নিজের রাজ্যে। প্রশ্ন হল কি এমন দেখানো হয়েছে এই ট্রেলারে, আর বিষয়বস্তুটাই বা কি এই চলচ্চিত্রের?যার ফলে এতো বিতর্ক।
কেরলের কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়ে যারা পড়াশোনার তাগিদে বাড়ি ছেড়ে কলেজে গেলে, কিভাবে তাদের মগজ ধোলাই করে, এবং মুসলিম ছেলেদের দ্বারা প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ের মাধ্যমে তাদের ধর্মান্তরিত করা হয় এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। অতঃপর তাদের আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে পশ্চিম এশিয়ার কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন ISIS দ্বারা কিভাবে সন্ত্রাস মূলক কাজে তাদের লিপ্ত করা হয়। আর এখানেই রয়েছে বিতর্কের কারণ। কারণ এই চলচ্চিত্রের ট্যাগ লাইনে ‘আনকভারিং দ্য ট্রুথ দ্যাট ওয়াজ কেপ্ট হিডেন’ বা সত্য উদ্ঘাটনের কথা বলা হলেও, বাস্তবে এর বাস্তবিকতা কতখানি, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
দ্য কেরালা স্টোরি |
পরবর্তীতে চলচ্চিত্রটি বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে কেরলে চলে আসা লাভ জিহাদ এর মাধ্যমে ধর্মান্তরণের ভয়াবহ বাস্তবিক চরিত্র বলেই প্রচার করা হচ্ছে। যার ফলে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল থেকে সংগঠন, সকলের কন্ঠে শোনা গিয়েছে চলচ্চিত্রের জয়জয়কার।
বিতর্কের পক্ষে বিপক্ষে ও রাজনৈতিক চাপান উতোর
ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী আদাহ্ শর্মা ওরফে শালিনী উন্নিকৃষ্ণণ। স্বাভাবিক ভাবেই ২০০৮ সালে হিন্দি ভাষার ভৌতিক ছবি ১৯২০-এ র মাধ্যমে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং পরবর্তীতে হিন্দি ও তেলুগু ভাষার চলচ্চিত্র গুলিতে অভিনয় করেন, কিন্তু প্রথম ছবির পর তেমন কোন বড় সাফল্য আসে নি, আর দ্য কেরালা স্টোরি তার কাছে একটি বড় সাফল্য হতে পারে। এই চলচ্চিত্রে হিন্দু মালয়ালি নার্সের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সুতরাং এই বিতর্কে তার মুখ খোলাই স্বাভাবিক। তার মতে চলচ্চিত্রটি ইসলাম বিরোধী নয়। আবার একিভাবে সরব হয়েছেন প্রযোজক,পরিচালক সকলেই। প্রযোজক বিপুল শাহ জানান, কোনও ধর্মীয় বিরোধীতার গল্প নয়, বরং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কাহিনিই দ্য কেরালা স্টোরি। আমার মনে হয় পরিস্থিতি এখন উত্তপ্ত, স্বাভাবিক হলেই মানুষ নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন। সেই সঙ্গে এটাও বুঝবেন যে দ্য কেরালা স্টোরি কারও ভাবাবেগে আঘাত করার জন্য তৈরি হয়নি। এটা সম্পূর্ণ সন্ত্রাস দমনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র। যারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়তে চান তাঁদেরকে আমাদের দলে যোদগানের জন্য সাদর আমন্ত্রন জানাচ্ছি।"
অন্য দিকে বিপক্ষে বলতে গিয়ে অনেক রাজনীতিবিদ তাদের এই চলচ্চিত্রের ধর্মান্তরকরণের তথ্যটির উপরে প্রশ্ন ছুড়ে ফেলেছেন। তাদের মতে, দ্য কেরালা স্টোরির বিষয়বস্তু সমাজে বিভেদ তৈরি করবে। এই ছবি প্রসঙ্গে কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেন, কেরলের বদনাম ছড়ানোর উদ্দ্যেশ্যেই এই ধরণের প্রোপাগান্ডা মূলক ছবি বানানো হয়েছে। পাশাপাশি বিরোধী দলের সকলের মন্তব্য - "২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন এবং ২০২৬-এর কেরল বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখেই হিন্দুত্ব মূলক ভাবাবেগকে কাজে লাগাতে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’কে ব্যবহার করা হচ্ছে।" এই বিষয়ে মনে করিয়ে দেওয়া ভালো ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেও এই চলচ্চিত্রের প্রশংসা করেছেন।
এই চলচ্চিত্রটি যে স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত হানতে পারে সেটি অনুধাবন করে ভারতের অনেক রাজ্যে চলচ্চিত্রটি বেন করা হয়েছিল, যেমন তামিলনাড়ু, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও তার জন্য যেতে হয়েছে আদালত পর্যন্ত, যদিও চলচ্চিত্রটি বাংলায় ছাড়পত্র পেল।
তথ্য কি বলছে
চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, কেরল থেকে ISIS এর ফাঁদে পড়ে ৩২ হাজার হিন্দু এবং খ্রিস্টান মেয়েরা ধর্মান্তরিত হয়ে জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেয় এবং যাঁদের আজও খোঁজ নেই। এর পূর্বেও এমনি একটি তথ্যচিত্র তৈরী হয়েছিল যার নাম ছিল ‘ইন দ্য নেম অফ লাভ’ যার বিষয়বস্তু ‘লভ জিহাদ’। পরিচালক সুদীপ্ত সেন তাঁর চলচ্চিত্র দ্য কেরালা স্টোরিতে দাবি করেছিলেন তার দেখানো তথ্যগুলো সঠিক। যে বিষয়ে ২০১১ সালে কেরল সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী উম্মেন চণ্ডী বিধান সভাতে ঘোষণা করেছিলেন প্রত্যেক বছর কেরালা রাজ্যে ২৮০০ থেকে ৩২০০ জন মেয়েরা ধর্মান্তরিত হচ্ছে। যদিও তিনি তার বক্তব্যে জঙ্গি সংগঠন ISIS-এর কোনও উল্লেখ করেননি। আবার তার আগের বছর সেই রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভিএস অচ্যুতানন্দ দাবি করেন, আগামী ২০ বছরে কেরলকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে পরিণত করাই লক্ষ্য অধুনা বেআইনি ঘোষিত পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার (PFI)। তৎকালীন সময়ে এই বিষয়ে চর্চা হলেও সরকার বা সংবাদমাধ্যমের কেউ এই বিষয়ে তেমন কোন প্রমাণ দিতে পারেনি।
অপরদিকে পরিচালক সুদীপ্ত সেন কেরলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভিএস অচ্যুতানন্দের ২০ বছরের বক্তব্য এবং উম্মেন চণ্ডীর বাৎসরিক ৩২০০ জন মেয়েদের ধর্মান্তরিত হবার দাবিকে কাজে লাগিয়ে, পরবর্তী ১০ বছরের হিসেব কষেই ৩২ হাজারে পৌঁছেছে বলে চলচ্চিত্রে তুলে ধরেছেন। যদিও এই বিষয়ে পরিচালককে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন সময় এলেই প্রমাণ পেশ করবো। কিন্ত তার ৩২ হাজার মেয়েদের ধর্মান্তরিত হবার সপক্ষে কোনো প্রকার প্রমান না থাকার দরুন একধাক্কায় সংখ্যাটি নিচে নামিয়ে আনেন, তবে কি পরিচালকের দাবি সম্পূর্ণরূপে বোগাস।
NIA ( ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) এর ২০১৬ এর রিপোর্ট অনুযায়ী মাত্র তিন জন মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মে যুক্ত হয়েছিলেন এবং ISIS এর গতিবিধিতে যোগ দেন। আবার যার মধ্যে দুজন খ্রীষ্টান এবং মাত্র একজন হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছিল। কিছু কিছু সংবাদপত্রের রিপোর্টে এও বলা হয়েছে যে ভারত থেকে যারা ISIS যুক্ত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে বেশি ভাগ ছিল পুরুষ, এবং তাদের শিংহভাগ কেরালা ব্যাতিত অন্য রাজ্যের তেলেঙ্গানা, কর্নাটক এবং মহারাষ্ট্রের ছিল। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি.কিশান রেড্ডী বলেছেন যে ভারতে গুপ্তচর সংস্থাগুলো জানতে পেরেছে জঙ্গি সংগঠনগুলো জঙ্গি সংযুক্তির জন্য DARK WEB এর সাহায্যে নিচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন সময়ে তাদের রিপোর্টে দেখিয়েছেন কেরালায় লাভ জিহাদের অনুপ্রেরণায় তেমন ভাবে মেয়েদের জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত করা হয়নি।
সুতরাং বলাই যাই ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ চলচ্চিত্রটি যদি দেখার মনস্থির করেই ফেলেন, তবে শুধু মনোরঞ্জনের জন্য দেখতে পারেন। এই প্রসঙ্গে "ডার্টি পিকচার" এর প্রবাদ-প্রবচনটি মনে পরে যাই, চলচ্চিত্র শুধুমাত্র তিনটি জিনিসের উপর নির্ভর করে চলে সেটি হল মনোরঞ্জন, মনোরঞ্জন, এবং মনোরঞ্জন। আর সেই কারণেই হয়তো সুপ্রীম কোর্ট রায় ঘোষণা করেন- দ্য কেরালা স্টোরি প্রেক্ষাগৃহে চলার সময় প্রথমে অবশ্যই দেখাতে হবে এটি যে কাল্পনিক চরিত্র ও ঘটনার উপর নির্মিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন