হিজরী সন
মক্কাতে মুসলিম জগতের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ জন্মগ্রহণের পর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় চলে যান, যা মুসলিম জগতের কাছে হিজরত নামে পরিচিত, এবং এই ঘটনাটিকে সাক্ষ্য রেখে ইসলামী চন্দ্র পঞ্জিকার সংযুক্তি ঘটিয়ে এক বিশেষ দিনপঞ্জি এর সূচনা করা হয় যা মুসলিম জগতের কাছে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল যেটি হিজরী সন হিসেবে পরিচিত।
তবুও একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, মুসলিম জগতের জন্য নিয়োজিত একটি কালপঞ্জী কিভাবে বাংলার বাঙ্গালীর জীবনধারায় জায়গা করে নিতে পেরেছে?
হিজরী থেকে বঙ্গাব্দ
আকবরের ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে জন্ম হলেও কিশোর বয়সেই ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে আকবরের রাজ অভিষেক ঘটে। আকবরের সাম্রাজ্যের প্রজারা বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা ছিলেন, এমন অবস্থায় সাম্রাজ্যের সঃহতি নষ্ট না হয় সেই দিকেই নজর রেখে নিজের দ্বারা তৈরী ধর্ম 'দীন-ই-ইলাহি’ প্রচলিত করেন। যদিও তার আমলের আগে থেকেই ইসলামী হিজরি পঞ্জিকা অনুসরণ করে ভূমি রাজস্ব আদায় করা হতো, তবুও সমস্যা থেকে যাচ্ছিল। মূলত চান্দ্রমাস ধরে চলে বলে, ইসলামিক হিজরী ক্যালেন্ডারটি বাংলা ঋতুর সঙ্গে মিল করতে পারছিলনা। আবার অন্যদিকে বাংলা দিনপঞ্জি তৈরি হয়ে আসছিল বরাহমিহীরের জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’র উপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে ইসলামি চন্দ্র পঞ্জিকায় শুধু ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিন থাকাই হিজরি বছরকে দশ দিন পিছিয়ে খুব সহজেই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিতে বা বাংলা বর্ষপঞ্জিতে পরিবর্তন করা যেত । তাই আকবর তার রাজস্ব ব্যবস্থাকে সহজতর করার পাশাপাশি আকবরের নিজের প্রবর্তিত ধর্ম ‘দীন-ই-ইলাহি’ কে স্বরনীয় করার লক্ষ্যে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে হিজরী সনকে সৌর বছরে মিশ্রিত করে বাংলা সন চালু করেন। তখন এই ক্যালেন্ডারটির নাম দেওয়া হয়েছিল, 'তারিক-ই-ইলাহী', অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের তারিখ’ , আবার অন্য মতে ফসল কাটার সময় হিসাবে ‘ফসল-ই-শান’। এইভাবে নতুন বর্ষপঞ্জিতে মিশে গেল ইসলামি বর্ষপঞ্জিতে, সূর্য সিদ্ধান্ত এবং আকবরের রাজত্বের তারিখ।
অন্য মতবাদ
পহেলা বৈশাখের প্রবর্তক আকবর |
প্রাচীনকালে হিন্দুরা যে বর্ষপঞ্জি পদ্ধতি গড়ে তুলেছিল তার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের জন্য বর্ষপঞ্জি তৈরি করা। তবে প্রাচীন ভারত জ্যোতির্বিদ্যায় অনেক উন্নত ছিল, তাই পণ্ডিতরা সূর্য, চাঁদ ও গ্রহের চক্র পর্যবেক্ষণ এবং গণনা করে সময় রাখার চেষ্টা করতেন।
সুতরাং "বঙ্গাব্দ" শব্দটি আকবরের আমলে নতুন কিছু নয়। বাংলা অঞ্চলে পাওয়া পাণ্ডুলিপিতে অধিকাংশ স্থানেই শকাব্দ এবং কিছু কিছু স্থানে শুধুমাত্রই তারিখ দেয়া আছে, সেই তারিখগুলি সুস্পষ্টরূপে বঙ্গাব্দের। যাই হোক বঙ্গাব্দ প্রচলনের চারটি মতবাদ রয়েছে।
প্রথম: সম্রাট আকবর
দ্বিতীয়: সুলতান হুসেন শাহ
তৃতীয়:তিব্বতীয় শাসক স্রং-সন-গাম্পো
চতুর্থ: গৌড় বঙ্গের প্রথম সার্বভৌম রাজা শশাঙ্ক
সুলতান হুসেন শাহ
পুঁথি-গবেষক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য বাংলা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সন-তারিখ সম্পর্কে গবেষণা করে তার গবেষণা পুস্তক ‘ তালিকা সমন্বয়’এ বলেছেন, “সুলতান হোসেন শাহের সময়ে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন চালু হয়েছে। তার মতে ইলিয়াস শাহ নিজেকে ‘বাঙালি’ বলে পরিচয় দিতেন। তাই তার আমলে বঙ্গাব্দ চালু হতে পারে। তবে এই যুক্তি অত গ্রহনযোগ্য নয়।
আবার একিভাবে তিব্বতীয় শাসক স্রং-সন-গাম্পোর দ্বারাও এটি প্রচলিত হয়নি বলে ঐতিহাসিকরা মত প্রকাশ করেন।
আরো পড়ুন - ভারতের নতুন শিক্ষানীতি
শশাঙ্ক
অনেক ইতিহাসবিদ কর্ণসুবর্ণের হিন্দু রাজা শশাঙ্ককে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তক বলে মনে করেন,কেননা বঙ্গাব্দ (বাংলা সন) শব্দটি আকবরের সময়কালের চেয়ে বহু শতাব্দী পুরনো দুটি শিব মন্দিরেও পাওয়া যায়,বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করেছিলেন, এবং শশাঙ্ক সিংহাসনে ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে আরোহণ করে বঙ্গাব্দ চালু করেছেন বলে অনেকে মনে করেন, এবং কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এই মতবাদকে সঠিক বলে প্রমাণিত করতে তৎপর হয়েছে।
তবে ইতিহাস যাই বলুক বাঙ্গালীর মনে বাংলা বর্ষপঞ্জি জায়গা করে নিয়েছে এবং তার অনন্তকাল থাকবে।
WhatsApp
FINDING HISTORY BY ME
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন