ধার্মিক হওয়া ভালো ধর্মান্ধ নয়। কিন্ত বিগত এক দশকে ভারতের মাটিতে ধর্মকে কেন্দ্র করে যা চলে আসছে তার আগামীদিনের উপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে, তার কিছুটা আন্দাজ করা কঠিন নয়। ভারতীয় সংবিধানে ভারতকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলা হয়েছে, কিন্তু এই ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বেশ কিছু সংগঠন ভারতকে "হিন্দু রাষ্ট্র" ঘোষণা করার এক অদ্ভুত লড়াই সংগ্রামে মেতে উঠেছে। যার আঁচ গিয়ে পড়েছে মুসলিম সহ ভারতের অন্যান্য ধর্মের উপরেও। ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম হিন্দু, এর পূর্বেও এমনটি নয় যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম হিসাবে হিন্দু ধর্মের তথাকথিত কট্টরপন্থী সংগঠনগুলো অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের উপর আঘাত হানে নি। তবে নাটকীয়ভাবে ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তাদের শাসন শুরু করার পর থেকে খ্রিস্টান-বিরোধীরা একটু একটু করে বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং এই সময় থেকেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), বজরং দল এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে কাজ করতে তৎপর হয়ে ওঠে। আগামী ২০০৪ সালে কেন্দ্রে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে সেটিও কিছুটা প্রশমিত হয়। কিন্ত ১৯১৪ সালের ২৬শে মে মাসে পুনরায় কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টি নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে নরেন্দ্র দামোদর মোদী প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসলে তথাকথিত হিন্দু কট্টরপন্থী সংগঠনগুলোর দ্বারা অন্যান্য ধর্মের উপরে উপদ্রব চড়া হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে, যার প্রভাব খ্রীষ্ট ধর্মের উপরেও দেখা যায়।
হিন্দু কট্টরপন্থীদের ধারনা
উচ্চবর্ণের হিন্দুদের একাংশ মনে করেন "হিন্দুস্তান " পক্ষান্তরে "ভারত" শুধুমাত্র হিন্দুদের সমাজ ব্যবস্থা দ্বারাই শাষিত হওয়া উচিত। এমন অবস্থায় কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলো ভয় পান যে ভারতে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের আগমন, তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং পাশাপাশি খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতা হিন্দুদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে পারে, এবং এমনটি চলতে থাকলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (VHP), বজরং দল এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) দ্বারা প্রচারিত "রাম রাজ্যে" প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। এই সংগঠনগুলি সকলেই যুক্তি দেখিয়েছে যে যেহেতু হিন্দুরা ভারতীয়দের একটি বড় অংশ তৈরি করে, তাই ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হওয়া উচিত। এই ডানপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলো তাদের স্বেচ্ছাসেবকদের বিশ্বাস করতে শেখায় যে ভারত শুধুমাত্র হিন্দুদের জন্য এবং বাকি মুসলিম, খ্রীষ্টান সকলেই বহিরাগত আক্রমণকারী, সুতরাং তাদের ভারত থেকে উৎখাত করাই বাঞ্ছনীয়।
বিভিন্ন রিপোর্ট
স্বাধিনতা লাভের পরবর্তী কয়েক দশক ভারতের ধর্মিয় সম্প্রীতি অন্য মাত্রা পেয়েছিল।
খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে হিংসার শতাধিক ঘটনা প্রতি বছর বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা রিপোর্ট করা হয়। যার মধ্যে অন্যতম ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা মন্ত্রক এবং সংখ্যালঘুদের জাতীয় কমিশন (NCM)। এই কমিশন গুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতি বছর খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে শতাধিক ধর্মীয় হামলার তালিকা তৈরি করে। যে তালিকায় ঘনঘন উঠে এসেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) এর নাম। কিন্তু স্বাধিনতার আগে থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) তার শিকড় ছড়াতে শূরু করেছিল। ১৯৯৯ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রিপোর্টে বলেছে যে কিছু রাজনৈতিক দল তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নবাদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে তৎপর। এবং এতে এও বলা হয়েছে যে ভারতে খ্রীষ্টান মিশনারীদের দ্বারা উপজাতীয় ও দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার এছাড়া শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য এবং আর্থিক সহায়তাকে অপপ্রচারের নাম দিয়ে মিশনারী খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিদের উপর আক্রমণ করতে শুরু করেছে কট্টরপন্থী ডানপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলো।
ভারতীয় খ্রিষ্টানরা কি বাস্তবেই শঙ্কিত |
রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৬৪ থেকে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আক্রমণ চলতে থাকে এবং কালক্রমে তা প্রতিবছর বাড়তে শুরু করে। ১৯৬৪ থেকে এখন পর্যন্ত হাজারের উপরে ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে গীর্জায় অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর অন্যান্য খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠানের ভাংচুর, বাইবেলের কপি পোড়ানো, যাজক ও ধর্মপ্রচারকদের হত্যা, জোর করে খ্রিস্টানদের ধর্মান্তরিত করা, মারপিট, জোর পূর্বক স্থান পরিবর্তন করা, যৌন নিপীড়ন, খুন, ধর্ষণ এবং খ্রিস্টান স্কুল, কলেজ এবং কবরস্থান ধ্বংস করা।এই বিষয়ে মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে হিন্দু কট্টরপন্থী সংগঠনগুলোর দ্বারা যে সমস্ত হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে তার মাত্র ১০% রিপোর্ট করা সম্ভব হয়েছে।
ভারতের জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন (NCM) ২০০১ সালের নভেম্বরে একটি সমীক্ষা প্রকাশিত করে, যেখানে বলা হয়েছে ১৯৯৮ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP) ক্ষমতায় আসার পর থেকে খ্রিস্টানদের অত্যাচার বহুগুণ বেড়েছে। ভারতীয় জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের মতে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মোট ৩৬৩ টি হামলা চালানো হয়েছে খ্রীষ্টানদের প্রতি। আবার মে বছর এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয় সেই বছরই সর্বভারতীয় খ্রিস্টান কাউন্সিল রিপোর্ট করে যে ভারতীয় খ্রিস্টানরা প্রতি ৩৬ ঘণ্টায় একবার করে আক্রমনের শিকার হতে হচ্ছে। আবার একিভাবে ২০০৮ সালে ভারতের জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন রিপোর্ট করেছিল - মে সমস্ত রাজ্যে BJP শাষিত ছিল, সেই সমস্ত রাজ্যে খ্রীষ্টানদের উপর অবিশ্বাস জনক ভাবে হিংসাত্মক ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল।
২০১৪ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রিপোর্ট করেছিল উত্তরপ্রদেশে সাম্প্রদায়িক আক্রমন সবথেকে বেশি হয়েছে।
ইভাঞ্জেলিক্যাল ফেলোশিপ অফ ইন্ডিয়া (EFI) অনুসারে ২০১৭ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে খ্রীষ্টানদের বিভিন্ন উৎসবের সময় কট্টর হিন্দুদের আক্রমন বৃদ্ধি পেয়েছে BJP শাষিত রাজ্যে। গির্জা এবং বাড়িতে সেই রাজ্যগুলিতে উপাসনা বাধাগ্রস্ত করতে এবং বাধা দিতে পুলিশ প্রযন্ত ব্যবহার করা হয়েছে।
ভারতীয় রিপোর্টেই যে খ্রীষ্টানদের প্রতি এমন অমানবিক তথ্য উঠে এসেছে তা নয়। আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা এবং সংবাদপত্রে এই ভয়াবহতার সত্যতা প্রকাশ করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ(VHP), বজরং দল , এবং আরএসএস হল ভারতে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার জন্য সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত সংগঠন। ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারনেশনাল রিলিজিয়াস ফ্রীডম (USCIRF) অন্য দেশগুলির সাথে ভারতকেও সংখ্যালঘু নিপীড়নে টিয়ার-1 হিসাবে স্থান দিয়েছে। এছাড়াও একটি বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট "খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সামাজিক আক্রমনের বৃদ্ধি"র জন্য ভারতের সমালোচনা করেছিল। এমনকি ভারতের খ্রীষ্ট ধর্মের অনুসারীদের এই শোচনীয় অবস্থার দরুন মানবাধিকার সংস্থাগুলো ২০২১ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ সর্বমোট ১৮ টি মানবাধিকার সংস্থা ভারতে খ্রিস্টানদের ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল।
সমালোচনা
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকে গেরুয়া সঙ্ঘ পরিবার হিন্দু ধর্মের প্রচারের জন্য গঠনমূলক সামাজিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল ঠিকই। কিন্তু পাশাপাশি এটিও অবগত হওয়া উচিত যে হিন্দু ধর্মের চিন্তাধারার মধ্যে বর্ণবাদ থাকাই স্বাভাবিক ভাবেই দলিত, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতি আকর্ষিত হয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা মনে করেন যে- যেভাবেই হোক খ্রিস্টান জনসংখ্যা বাড়লে তা নির্বাচনী রাজনীতির গতিশীলতা এবং হিন্দু জাতি হিসেবে ভারতের মর্যাদাকে প্রভাবিত করবে। কিন্তু বাস্তবে এমনটা সম্ভবপর নয় কেননা ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতের মাটিতে খ্রীষ্ট ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা মাত্র ২.৩%।
এযাবৎ যতগুলো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তার সবগুলোতেই ভারতীয় জনতা পার্টির মদতপুষ্ট কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলোর নাম উঠে এসেছে, এবং যারা এই নারকীয় ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে তাদের বেশিরভাগই ছিল নামধারী অপরাধীরা। সুতরাং বলাই যাই ভারতের মত এমন ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এই সংগঠনগুলো হিংসার জন্ম দিয়ে চলেছে। আর এই কারনেই হয়তো পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শ ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর অহিংস মনোভাবের কথা উল্লেখ করে খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে অহিংসার বিশ্বাস গড়ে তোলার কথা বলেন। এবং তার পরের দিনই ১৩ অক্টোবর ২০০৮ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং- এর সভাপতিত্বে ভারতের জাতীয় সংহতি পরিষদে একটি বিশেষ সভা আহ্বান করা হয়েছিল, যেখানে তিনি বজরং দল, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকের মতো হিন্দু জঙ্গি সংগঠনগুলির নিন্দা করেছিলেন এবং প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন যে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এই হিংসা একটি বড় "জাতীয় লজ্জা"।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন