মালো আর মালপাহাড়ির, কখনও বা মালো ওঁরাও আবার খুবই কিঞ্চিৎ পরিমানে এই তিনটির স্থান বেশে সহবস্থান তাদের জাতি গত পরিচয়ে অনেকেরই কাছে ভুলভ্রান্তির সৃষ্টি করে থাকে, কেননা চরিত্র গত, রুচি গত, ব্যবহার গত এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংষ্কৃতি গত মেলবন্ধন থাকার ফলে এমনটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে জনমানবে।
আদিবাসী মালোরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তথা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে খুবই অল্প সংখ্যায় ছরিয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, ফলস্বরূপ মালোদের মধ্যে সংষ্কৃতিক উন্নয়ন থমকে রয়েছে বললেই চলে।
ব্রিটিশ ভারতে চায়ের বাগান তথা রেলপথ স্থাপনে দক্ষ কর্মীর চাহিদা পূরণ করার সুবাদে আদিবাসী মালোরা পূর্ব তথা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে।
জাতিগত পরিচয়
ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি এলাকায় এদের অবস্থান ছিল এবং কালক্রমে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। মালোরা দ্রাবিড়ীয়ান জাতি গোষ্ঠীর হবার সুবাদে , দ্রাবিড়ীয়ান অন্য জাতিবর্গের সাথে মিল পাওয়া যায়। মালো এবং অন্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মিল থাকার দরুন মালোরা প্রায়শই আত্ম পরিচয় হীনতায় ভুগে থাকেন। যার ফলস্বরূপ কিছু কিছু মালোরা তাদের পরিচয় অক্ষত রাখতে "মালো" শব্দটিকেই টাইটেল হিসেবে ব্যবহার করে। তবে এছাড়াও মালোরা নায়েক, রাজ, শিং, সরকার, মন্ডল, ভূঁঞা পদবীকে টাইটেল হিসেবে ব্যবহার করেন।
মালো মহিলা |
ভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের জীবিকা তাদের পরিচয় বহন করে, যেমন কারো পেশা মধু সংগ্রহ, আবার কারো বাঁশের বিভিন্ন দ্রব্যাদী তৈরি, কিন্তু মালোদের বিষয়ে সঠিক ভাবে বলা না গেলেও মনে করা হয় তাদের প্রধান জীবিকা ছিল মাছ ধরা। তবে বর্তমানে এদের বেশিরভাগই চাষবাসকে প্রধান জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছে (এর অর্থ এই নয় যে এরা অন্য কাজ করে না।)।
মালোদের ইতিহাস
মালোরা বরাবরই শান্তিপ্রিয় জাতি, তথাপি ঝাড়খন্ড প্রদেশ থেকে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ার সুবাদে তাদের মৎস্য শিকারের জায়গা থেকে সরে পড়লে, মালোরা চাষবাসের কাজে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেয়, কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের লাগামহীন কর এবং অত্যাচারে এরাও কৃষক বিদ্রোহী গুলিতে শামিল হয়। এই সময় বৃটিশ সরকারের হয়ে কর ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতো জমিদাররা, কিন্তু কৃষক বিদ্রোহে কৃষকদের পরাজয় কালক্রমেই মালোদের জমিদারের আশ্রিত প্রজাতে পরিণত করে। এইভাবে মালোরা কখনো জমিদারের ঘোড়ার, কখনও জমিদারের লাঠিয়াল, কখনও গোবাদি পশুর দেখভাল, ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে তাদের একপ্রকার স্বকীয়তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
সমাজ ব্যবস্থা
রিজলে, বুচানান প্রমূখ তাদের আদিবাসী বিষয়ক পুস্তকে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে কিছু তথ্য প্রদান করেছেন, যা কালক্রমে বিভিন্ন স্থানে পরিবর্তন হয়েছে, তাদের মতে মালোরা সাদরি ভাষায় কথা বলে, তবে স্থান ভেদে বিভিন্ন স্থানে বাংলা অপভ্রংশ, অথবা হিন্দি অপভ্রংশ (বাংলা এবং হিন্দি মিশ্রিত দ্রাবিড় গোত্রীয় ভাষা) ব্যবহার করে থাকে। রিজলে তার পুস্তকে বর্ননা করেছেন - অন্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মত মালোদেরও সমাজে মাঝিহারাম (মোড়ল) দ্বারাই সমাজ ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। এবং মাঝিহারামকে সহযোগিতা করতে আরো বিশেষ দুটি পদ পারমানিক ও গুরদিক রয়েছে।
আরো পড়ুন - বোকা আদিবাসী চালাক হও সময় হয়েছে পরিবর্তনের।।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পিতার পরেই বড় ভাইয়ের কাঁধে দায়িত্ব তুলে দেন মালোরা। মালোদের প্রকৃত ধর্ম বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা না গেলেও, বর্তমানে মালোদের মধ্যে হিন্দু ধর্মের আধিক্য দেখা যায়, তবে হিন্দু ধর্মে মালোদের নিম্নবর্গের মনে করা হয়, যার ফলে মালোদের বেশ কিছু অংশ বিশেষতঃ বাংলাদেশে তাদের মধ্যে খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতি আকর্ষণ দেখা গেছে। অন্য ভারতীয়দের মত এরাও ভাত, সব্জী, মাংস হিসেবে মুরগি, ছাগল, শূয়োরের মাংস খেয়ে থাকে, তবে যারা হিন্দু ধর্মের অনুসারী তারা শূকর খান না। উৎসবের আয়োজনে হাড়িয়া প্রধান পানীয় হয়ে ওঠে।
মালোদের বিষয়ে কিছু কথা
একসময় মালোদের স্বকীয়তা ছিল হয়তো, আমার মতে তা হারিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, কারন হিসেবে বলা যেতে পারে অশিক্ষা, নিজস্বতার প্রতি ওয়াকিবহাল না থাকা ইত্যাদি। প্রথমেই মনে করিয়ে দিই যে মালোরা এমন একটি জাতি যারা আত্মপরিচয়ের অভাবে ভুগছে, পাশাপাশি শিং, মন্ডল, সরকার ইত্যাদি পদবী গুলোকে ব্যবহার করাই তাদের প্রকৃত পরিচয় নষ্ট হচ্ছে। আবার ইতিহাস বলছে জমিদারের আমলে তারা ঘাসী, বুনি হিসেবে পরিচয় পেয়েছিল, যা তাদের গানেও বর্তমান ‘রাঁচি থেকে আসলো ঘাসী, তারপর হলো আদিবাসী।’ এই সমস্ত বিষয়গুলো থেকে অনুমেয় যে তারা তাদের পরিচয় রক্ষার্থে খুব একটা সচেষ্ট নন, তার ফলস্বরুপ তারা আদিবাসী অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পাশাপাশি অশিক্ষা তাদের অগ্রগতিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, আবার স্বল্প বয়সে বিয়ে এদের মধ্যে খুব দেখা যায় ফলে অপরিপক্ক অবস্থায় পিতা মাতায় পরিনত হওয়া মালোরা আগামী প্রজন্মকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারে না। বর্তমানে বাংলা ভাষাকে প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহার করলেও যেখানে অন্য আদিবাসীদের সহবস্থান দেখা যায় সেখানে মালোরা সেই ভাষাকেই আপন ভাষা হিসেবে করায়ত্ত করে ফেলে, উদাহরণ স্বরূপ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় মালোদের সংখ্যা তুলনামূলক অন্য সকল রাজ্য থেকে বেশি, তবে ওঁরাওদের সাথে সহবস্থান মালোদের ভাষাকে সাদড়ী ভাষায় পরিনত করেছে। যা একপ্রকার ভাষা গ্রাস বলা যেতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন