কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের একাংশ বলছেন তাদের ধর্মাচরণের রীতিতে কিছু কিছু হিন্দু রিতির মিল থাকলেও মূলত তারা প্রকৃতি পূজারী। নিরপেক্ষতার বিচারে সর্বাঙ্গীন এক সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়া কার্যত সিমাহীন। সেইসূত্ৰে ধর্ম আর ধর্মাচারকে গুলিয়ে ফেলা বোধ হয় ঠিক হবে না। বাস্তব পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে, তাই যেকোন শ্রেণিবিন্যাসের আগে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বাস্তবে 'আদিবাসী' সম্বন্ধে যথার্থ ধারণার ক্ষেত্রে ভারতিয় জনগনের শিংহভাগের মধ্যে বেশ কিছুটা দূৰ্বলতা আছে। তবে ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের আদিবাসী সমাজের একটি বড় অংশ একটি পৃথক ধর্মের স্বীকৃতি চেয়ে বিধানসভায় সম্প্রতি একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন, যেখানে তাদের ধর্মটির পরিচয় দেওয়া হয়েছে 'সার্না" ধর্ম হিসাবে। এতেই আঁতে ঘাঁ পরেছে কিছু কিছু হিন্দু সংগঠনে, যেমন হিন্দু পুনরুত্থানবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের, তাদের মতে আদিবাসী সমাজ আসলে সনাতন হিন্দু ধর্মেরই অনুসারী। কিন্তু বিপরীতে বিশাল অঙ্কের আদিবাসীরা নিজেদের হিন্দু তকমা দিতে নারাজ। এই বিষয়ে খোদ ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন আদিবাসীদের পূৰ্বের জনগননার ন্যায় আলাদা ধর্মকোডের দাবি জানিয়ে মত প্রকাশ করে বলেন আদিবাসীরা হিন্দু নন, এবং এই বিষয়ে একটি বিলও পেশ করেন।
আদিবাসী সমাজ |
সারনা ধর্ম কোডের দাবীতে বিক্ষোপ প্রদর্শন |
ঝাড়খন্ডের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের পৃথক ধর্মকোডের প্রস্তাবটি যদি কেন্দ্রীয় সরকার সম্মতি প্রদান করে, তবে ভাবী আদিবাসীরা তাদের প্রকৃত ধর্মের মর্যাদা ফিরে পাবে, এবং হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি কলামের সাথে "সার্না" ধর্মের নামও উল্লেখ করা থাকবে।
শেষবার ২০১১ সালে জনগননা হয়েছিল। যেই জন-গননাই আদিবাসীদের ৯ % হিন্দু , ০.৫ % মুসলিম , ৩৬ % খ্রীষ্টান , ৭.৪ % বৌদ্ধ ধর্মে ,০.৯ শিখ ,২.৬ জৈন ,১৫.৯ জরাথুষ্ট্রিয়ান , ৮২.৫ % বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী হিসাবে উল্লেখ্য করা হয়েছে। আদিবাসী সংগঠনগুলোর দাবী এই বছরের জনগননাই (২০২১) আদিবাসী ধর্মের পৃথক পরিচয় দেওয়া হোক। আর তাদের এই দাবীকে জোরালো আকারে তুলে ধরতে গোটা ভারত-ব্যাপি রেল অবরোধের কর্মসূচিও গ্রহণ করেছিল "আদিবাসা সেঙ্গেল অভিযান"। ফলস্বরুপ মালদহেও শুরু হয়েছিল রেল অবরোধ। এই অবরোধে সমস্যায় পরতে হয়েছিল যাত্রীদের, তবে সবচেয়ে বেশী সমস্যায় পড়েছিল প্রায় দেড় হাজার পিএসসি পরীক্ষার্থীদের, কারন সেইদিনই ছিল পরিক্ষা, যাইহোক সেইদিনের অবরোধের জন্য পরবর্তীকালে শিলিগুড়িতে বিভিন্ন সেন্টারে পুনরাই তাদের পরীক্ষা নেওয়া হয়।
আরো পড়ুন - মহুয়া গাছ ও আদিবাসী সমাজ।
তবে এখনো সমস্যার শিকড় অনেক গভিরে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো আদিবাসীদের হিন্দুত্বে ফিরিয়ে আনার পক্ষে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে, এবং অনবরত হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘের বিভিন্ন শাখা সংগঠনগুলী বনবাসী কল্যাণ আশ্রম বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আদিবাসী অঞ্চলগুলিতে কাজ করে চলেছে। কিন্তু এক কদম পিছিয়ে প্রকৃত পরিচয়ের সাপেক্ষে পুনরাই আত্মসমালোচনার প্রয়োজন। প্রথমত. যেটা ভাবা দরকার তা হল, 'আদিবাসী' বলতে স্বাধীন ভারতে আমরা কাদের চিহ্নিত করি - ভারতের সংবিধানের ৩৪২ ধারা মতে রাষ্ট্রপতি একটি তালিকা প্রকাশ করেন, সেখানে যে জনগোষ্ঠীগুলির নাম থাকে তারা এসটি বা তপশিলী উপজাতি। ভারতীয় ইতিহাসের অনবরত ধারাই আদিবাসীদের মাঝেও জাতি, রিতি, ধর্মীও মতাদর্শের আদান-প্রদান ঘটেছে। যার দরুন ভারতীয় আদিবাসীদের মাঝেও দেখা গিয়েছে অদৃশ্য রুপান্তরকারী শক্তির অনুপ্রবেশ। সেই দরুন ধর্মীয় পরিচয়ের দিক দিয়ে হিন্দু আদিবাসী ছাড়াও রয়েছে ক্রিশ্চান ধর্মাবলম্বী আদিবাসী,রয়েছে বৌদ্ধ আদিবাসী- লেপচা, ভুটিয়া প্রভৃতি, এমনকি লাক্ষাদ্বীপের আদিবাসীদের শ্রেষ্ঠাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী একাধারে আদিবাসী। আর এই সত্যটিকে বাস্তবিক দর্পনের রুপ দেওয়া যাই তবে বর্তমানে আদিবাসীরা হিন্দুর পাশাপাশি বৌদ্ধ, মুসলমান এবং ক্রিশ্চানও বটে।
ভারতীয় আদিবাসী গোষ্ঠির একটি |
সার্না ধর্মের মত হিন্দু ধর্মের মধ্যেও সর্বাত্মাবাদ রয়েছে। ১৯১১ সালে ভারতীয় আদিবাসী সমাজের উপর তথ্য প্রকাশ করতে গিয়ে হার্বাট হোপ রিজলে বলেছিলেন- "আদিবাসী সর্বাত্মাবাদীরা আদিবাসীদের স্বকীয় ধর্ম পালন করে।" সুতরাং আদিবাসীদের স্ব মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পুনরাই তাদের পৃথক ধর্মের দাবী অগ্রাধিকার দেওয়াই বাঞ্চনীয়।
আরো পড়ুন - ডাইনি হত্যা ও আদিবাসী সমাজ।
WhatsApp UNIQUE KNOWLEDGE
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন